আজ মনে পড়ছে বড্ড অভিদার কথা, অভিজিৎ রায় নামের এক ম্যান উইদ দ্যা মিশনের কথা, এক সহাস্য, সদাতরুণ, সদালড়ুয়ে অথচ সজ্জনের কথা।

খুব ইচ্ছে করছি বলি, অভিদা, আপনাকে জড়িয়ে, আপনার হাত দুটো জড়িয়ে একটু বসে থাকি। অভিমানভেজা গলায় বলতে থাকি, দেখুন অভিদা, আজ সারাদেশের, সারা দুনিয়ার অবস্থা দেখুন। সাগরে ভাসছে রোহিঙ্গা অনিকেত, বাঙালি নিম্নবিত্ত; মরুতে, পরবাসে উদ্বাস্তু শিবিরে দুর্বিষহ জীবনযাপন করছে সিরীয় শরণার্থীরা; কচি বয়েসে অকথ্য যৌন নির্যাতন ও ক্রীতদাসীর বাজারে উঠছে ইয়াজিদি বালিকারা; পালাতে গিয়ে প্রাণ দিচ্ছে কুর্দি শিশুরা; নিজের রক্তে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকছে বাঙালি ব্লগারেরা; দেশের স্বৈরাচার হম্বিতম্বি করছে দ্বিদলীয় শাসনের মুখের উপর গণতন্ত্রের দাবিতে; অর্থনৈতিক সুবিধে বাড়ার সাথে সাথে তেজি হচ্ছে মৌলবাদের হুঙ্কার; নামকাবাস্তে প্রগতিশীল সরকার ক্ষমতায় থেকে স্বেচ্ছান্ধ হয়ে ধর্মান্ধদের সুবিধে করে দিচ্ছে ‘পাছে ভোট নষ্ট হয়’; শিশুনারীনির্যাতন, হত্যা ও ধর্ষণ প্রতিদিনকার পত্রিকার অবহেলিত খবরে রূপ নিয়েছে; ধর্মীয়-জাতিগত-চেতনাগত সংখ্যালঘুদের ওপর নিরন্তর নীরব নিষ্পেষণ অন্তহীন; দাঁত বের করে হাত কচলাচ্ছে হেজাবি জোট (হেফাজত-জামাত-বিএনপি) কারণ লীগসরকারের প্রতিটি অমানবিক সিদ্ধান্ত ও সিদ্ধান্তহীনতা তাদের ক্ষমতায়নের পথ আরো কয়েক গজ প্রশস্ত করছে…

এই অশ্লেষার রাক্ষসী বেলায় আপনার তীব্র অভিঘাতময় লেখনির, সুচিন্তিত সাদামাটা বিবেকবান কথাবন্ধের, কিবোর্ডের আন্দোলনে নেতৃত্বের অভাবটা বড্ড বেশি করে অনুভব করি বারংবার।

মনে পড়ে, শুধু মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথের মতো আশাবাদী, আনন্দময়, জীবনবাদী মানুষের চরম হতাশ পংক্তিগুলো:

শতাব্দীর সূর্য আজি রক্তমেঘ-মাঝে
অস্ত গেল, হিংসার উৎসবে আজি বাজে
অস্ত্রে অস্ত্রে মরণের উন্মাদ রাগিনী
ভয়ংকরী। দয়াহীন সভ্যতানাগিনী
তুলেছে কুটিল ফণা চক্ষের নিমেষে
গুপ্ত বিষদন্ত তার ভরি তীব্র বিষে।
স্বার্থে স্বার্থে বেধেছে সংঘাত, লোভে লোভে
ঘটেছে সংগ্রাম–প্রলয়মন্থনক্ষোভে
ভদ্রবেশী বর্বরতা উঠিয়াছে জাগি
পঙ্কশয্যা হতে। লজ্জা শরম তেয়াগি
জাতিপ্রেম নাম ধরি প্রচণ্ড অন্যায়
ধর্মেরে ভাসাতে চাহে বলের বন্যায়।
কবিদল চিৎকারিছে জাগাইয়া ভীতি
শ্মশানকুক্কুরদের কাড়াকাড়ি-গীতি।

ভোগবাদ আর মৌলবাদের অন্তহীন বেসামাল বাড়াবাড়ির ভেতরে জমা হচ্ছে যত অমানবিক, কুটিলতম, জঘন্যতম, নারকীয় অন্যায়। মানুষের চোখের একের পর এক প্রতিকারহীন অন্যায় হয়ে পড়ছে স্বাভাবিকতম ঘটনা, অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে মানুষ এসবে, কখনো নিজেই পড়ছে জড়িয়ে। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর এক লেখায় কিছুটা এরকম একটা কথা বলেছিলেন যে, মানুষ যখন পশু হয় তখন নিজের মুখোশে পশুত্বটা ঢেকে ফেলে বলে সে আরো ভয়ঙ্কর হয়, কারণ চেনার পথ থাকে না। তেমন অজস্র পশুতে ছেয়ে গেছে চারপাশ, কারণ বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদছে।

আপনার জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানানোর কোনো সুযোগ পেলাম না অভিদা, মনের ভেতর অদম্য ব্যথা, অক্ষম ক্ষোভের বরফগলা নদী হয়তো আমায় নিজেকেই ভাসিয়ে নিয়ে যাবে যদি অর্গল খুলে দেই।

তারচে বরং ভাবি, সেই কিশোরটির যে আপনার প্রথম বইয়ের প্রথম দিকের পাঠকদের একজন ছিলো, এবং পড়ে সে বিস্ময়বিমূঢ় হয়ে বিজ্ঞানের সৌন্দর্য ও সৌগন্ধে সচকিত হয়ে পড়েছিলো, যোগাযোগও করতে চেয়েছিলো হয়তো আপনার সাথে। তারপর ব্লগ নামের যৌবনমুখর, কলরবমুখর, চিন্তাতর্কলেখনমুখর ক্ষেত্রটিতে আপনার সাথে পরিচয়ের পর আপনারাই আমন্ত্রণে মুক্তমনায় লিখতে আসার সেই আনন্দময় মুহূর্তটির কথা, সেই সম্মানের কথা সে ভোলে নি এখনো। ভোলে নি মুক্তমনায় তার ব্লগজীবনে প্রদত্ত সেরা সম্মানটির কথা। ভোলে নি ২০১২-এর বইমেলায় আপনার সাথে সশরীরে দেখা হওয়ার উজ্জ্বলতম মুহূর্তটির কথা। সেসময় সে মুক্তমনা নিয়ে যেসব হাবিজাবি উচ্চাশার কথা, স্বপ্নের কথা বলছিলো আপনার সামনে এবং আপনি নীরবে শুনছিলেন, সম্মতও হচ্ছিলেন, সেটা যে তার জন্যে কতবড় ড্রিম কামস ট্রুয়ের মতো ছিলো, সেটা আপনি জেনেও যেতে পারলেন না! জানতে পারলেন না ২০১৫-এর বইমেলায় আপনার ও বন্যাদির তার সাথে দেখা, আড্ডাবাজি আরো কজন পরিচিত লেখক ও ব্লগার মিলে এবং পরদিন সকালে বাইরে তিনজনের একত্রে ঘন্টাভর গালগল্প, খাওয়াদাওয়া এবং কতো যে চিন্তাস্বপ্নপরিকল্পনা!

হায়, অধরা রয়ে গেলো যে অভিদা এখনো কতো কাজ, কতো ভাবনা, কতো কল্পনা!
আর তারপর সেই কৃষ্ণ ২৬শে!

না, অভিদা। আমি, আপনার ভাষায় বা অতিশয়োক্তিতে আপনার ‘প্রিয় মানুষ, প্রিয় লেখক’ আর লিখতে পারি না কিছুই। ভেবে, গুছিয়ে, চিন্তা করে কিছু পরিবেশন করতে পারি না। আপনি চলে-যাওয়ার সময় আমার আঙুলগুলো এভাবে চাপাতির সাথে কেটে নিয়ে গেলেন! বন্যাদিকে আঘাত থেকে একটুও তো বাঁচাতে পারলাম না অভিদা! আপনি ছাড়া আপনার জন্মদিন বন্যাদিকে কতোটা আহত করবে, ভাবার শক্তিটাই যে নেই এখন!

ফেব্রুয়ারি মাসটাই বুঝি রক্তাক্ত হয়ে গেলো। আর কখনো বইমেলায় যেতে পারবো কিনা জানি না অভিদা, সেই পথ আপনার রক্তে পিচ্ছিল হয়ে হায়েনার অট্টহাসিতে বন্ধ হয়ে গেলো হয়তো আমার জন্যে। শেষদিন খুব করে বারবার বলছিলেন, আমার কোনো বই তৈরি আছে? থাকলে আপনি ছাপানোর ব্যবস্থা করবেন। অন্যদের যদি ভালো বই পাই, তাও আপনি ছাপানোর ব্যবস্থা করবেন বলে বললেন। আরো যেসব কথা হলো, সব তো লিখতেও পারছি না এখন আর। কখনো পারবো কিনা, জানি না তাও!

স্ত্রী যখন রোগশয্যায়, তখন ভেবেছিলাম তার জন্যে হলেও নিজের একটা বই তাকে উৎসর্গ করে বের করবো, সেই স্বপ্ন পূর্ণ হয় নি। আপনার জন্যে, আপনি খুশি হবেন বলে কিছু লেখার, কোনো বই বের করার ইচ্ছে ছিলো, সেটাও হলো না আর। আমার পথে পথে পাথরই ছড়ানো থাকে অহরহ। সব জাহান্নামে যাক, শুধু আপনি যদি বেঁচে থাকতেন আজ অভিদা, যদি থাকতেন…

একটা ছোটো কাজ করেছি। বেশ কিছুদিন ধরে ভাবছিলাম, বিজ্ঞানের নানা দিক নিয়ে কিছু গান লিখবো। ভিনদেশে কতো কিছু নিয়েই যে গান বাঁধা হয়, আর আমরা শুধু যেন নচিকেতার আমি-তুমি-তুমি-আমির পারমুটেশন আর কম্বিনেশনে বন্দি! বিজ্ঞানও হয়ে উঠুক গানের অনুপ্রেরণা, উৎস ও সঙ্গী। যদিও সুরজ্ঞান তেমন নেই, তবুও লিখে ফেললাম। দেখা যাক, কখনো সুরাশ্লিষ্ট হয়ে মানুষের কানে বা গানের জগতে ধরা দেয় কিনা! আপনার জন্মদিনে উপহার হিসেবে এই অকিঞ্চিৎকর ব্যাপারটুকুই থাকলো, আপনার হাসিমুখটা মনে পড়ছে, আপনি খুব অখুশি হতেন না অভিদা আমি জানি…

মৌলের সবচেয়ে খুদে অংশের নাম,
বিক্রিয়াসক্ষম, পরমাণু বা এ্যাটম।
প্রোটন ও নিউট্রনে মিলে গড়ে কেন্দ্র,
নিউক্লিয়াস নামে সেটুকু অতন্দ্র।
আধানে ধনাত্মক প্রোটনচরিত্র,
নিউট্রনে আধানে নেই লেশমাত্র।
নিউক্লিয়াস ঘিরে পাক খায় কক্ষে
ইলেক্ট্রনের দল, নানাবিধ অক্ষে।
ইলেক্ট্রনের জানি আধান ঋণাত্মক,
এই তিন কণা মিলে পরমাণু সার্থক।
এস, পি কক্ষপথে ইলেক্ট্রনের দল
ওঠানামা করে বলে শক্তির চলাচল।
প্রোটন ও নিউট্রন মিলে পরমাণুভর,
ইলেক্ট্রনের ভর নগণ্য, কম দর।
কটা প্রোটন আছে পরমাণুটার ভেতরে,
তাই দিয়ে পারমাণবিক সংখ্যা ধরে।
কিভাবে ইলেক্ট্রন এ্যাটমেতে ছড়ানো,
তার নানা নীতি আছে, সবগুলো কী জানো?
পরমাণুরাজ্যের নিয়ম বিচিত্র,
বিজ্ঞানআলো দিয়ে এসো আঁকি চিত্র।

শঙ্কর নামের পশ্চিমবঙ্গীয় কথাসাহিত্যিকের এক কিশোর গল্প পড়েছিলাম। প্রাক্তন উচ্চপদস্থ এক পিতা তাঁর পুত্রের দুর্ঘটনায় অপঘাতমৃত্যুর পরও তাঁর কন্যার কাছে সন্তানের জন্মদিনের কেক পাঠান। বোনের করুণতর অনুভূতি, “চোখের জলে ভাসতে ভাসতে কেক কাটতে হয়।”
অভিজিৎদার জন্মদিনেও হয়তো আপনজনদের সেই বেদনাবহ অভিজ্ঞতা, এখন থেকে, কে জানে!

হায় মহাবিশ্ব, এতো বিপুল তুমি, এতোটাই সুবিস্তৃত, তারপরও আমাদের বেদনারাজি এতো সুগভীর, এতো অন্তহীন, এতো অমোচনীয়!