১। অজয় রায়। প্রিয় এই মানুষটির সাথে কয়েক বার দেখা হয়েছে আমার। প্রথম বার তাঁর বাসায়। শেষবার যখন দেখা হয়েছে তখন বৃষ্টি হচ্ছিল। তিনি এক বন্ধুর গ্রামের বাড়িতে এলেন। গাড়ি থেকে নামলে আমি এগিয়ে গিয়ে পিচ্ছিল পথটা হাতে ধরে ধরে নিয়ে এলাম বাসায়।

এই মানুষটি আমার মত অনেকের কাছে এক বিস্ময়। এই বয়সেও তিনি তরুণ, একদম সজীব। অস্ত্র হাতে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন, স্বপ্ন ছিল এক অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ যেখানে থাকবে না নিপীড়ন, মানুষ পাবে তার অধিকার। সেই মানুষটাকেই হতে হল সন্তানহারা। যে সন্তানকে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছিলেন সেই সন্তানের লাশ তোলে দেয়া হল তার কাঁধে। আজ তিনি বলেছেন, ব্লগার হত্যায় সরকারের প্রচ্ছন্ন সমর্থন রয়েছে।”

শ্রদ্ধেয় অজয় রায়, সরকারের প্রচ্ছন্ন সমর্থন শুধু নয়, সরকার প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করছে এই হত্যাকাণ্ডে। এত তথ্য খুনিদের হাতে কারা তুলে দিচ্ছে বলে মনে হয়? সেই ২০০৪ সালে হুমায়ুন আজাদের উপর হামলা হল, তার বিচার কি হয়েছে? রাজীব হায়দারকে হত্যা করা হল, অপরাধীরা ধরাও পড়ল, এর বিচার কি হয়েছে? সরকার তৌহিদী-মূর্খ জনতার সমর্থনের লোভে একের পর এক হত্যাকাণ্ডে ইন্ধন দিচ্ছে। অথচ এই তৌহিদী জনতার সমর্থন কস্মিনকালেও তারা পাবে না।

২। শেষ পর্যন্ত নিলয় নীলকেও খুন হতে হল। দিনে-দুপুরে একটা নিরস্ত্র-নিরীহ মানুষকে ‘আল্লাহু আকবার’ বলে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। ‘আল্লাহু আকবার’ মানে হচ্ছে ‘আল্লাহ মহান’। আল্লাহ পাক কতটা মহান তা প্রমাণ করা হয়েছে। এভাবে হাজার বছর ধরে সেটা প্রমাণিত হয়ে আসছে, আরো প্রমাণের অপেক্ষায় আছি।

যেখানেই ইমানদাররা আছে সেখানেই বোমানদার। জেএমবি বাংলাদেশের ৬৩ টি জেলায়ই বোমা হামলা করেছিল। মুসলমানরা একটি দেশে আছে, সেটা শতকরা চার ভাগ বা পাঁচ ভাগ হোক তারা বোমা মারবেই, মানুষ হত্যা করে প্রমাণ করবে ইসলাম একটা শান্তির ধর্ম এবং আল্লাহ মহান।

৩। নিলয় নীলকে হত্যায় উল্লসিত তৌহিদি জনতা মনে করে নাস্তিকদের নাকি নৈতিকতা নাই। একটা নিরস্ত্র-নিরীহ মানুষকে বর্বরভাবে হত্যা করে, উল্লাস প্রকাশ করে ও তা সমর্থন করে আপনারা যে ইমানি নৈতিকতা দেখালেন সেটা অবশ্য নাস্তিকদের নেই।

নিলয় একটি স্ট্যাটাসে বলেছে, আমি একটা জ্যান্ত মুরগী বা ইঁদুর মারতে পারি না কিন্তু ওরা কিভাবে একটা জ্যান্ত মানুষকে কুপিয়ে মেরে ফেলে বুঝি না!”

তার বিস্ময় কেটে গেছে। সে নিজের জীবন দিয়ে বুঝে গেছে কিভাবে ওরা একটা জ্যান্ত মানুষকে কুপিয়ে মেরে ফেলে।

৪। সকল ধর্মের মত ইসলামও অপ্রমাণিত ধর্ম। হ্যা, প্রমাণ নেই বিধায় বিশ্বাসের প্রয়োজন হয়, ইমান আনার প্রয়োজন হয়। আল্লাহ নাই, তাহলে কে সৃষ্টি করেছে? মাথাটা একটু ঠাণ্ডা করেন। এগুলো নিয়ে অনেক-অনেক আলোচনা করে মাথাটা নিলামে তুলে দিলাম, কিন্তু আপনাদের আর বুঝানো গেল না। আপনাদের বুঝানো গেল না যে স্রষ্টা বলতে এমনকি কেউ থাকলেও সে প্রচলিত ধর্মগুলোর ইশ্বর-আল্লা-ভগবান-গড-জিহোভা এগুলো হবে না। সে যুদ্ধ করার জন্য, মানুষকে হত্যা করার জন্য নির্দেশ দিবে না। সে উপাসনা পাওয়ার জন্য বেপরোয়া হবে না, লালায়িত হবে না। তাকে অবিশ্বাস করা এত বড় অপরাধ হবে না যে তার জন্য তিনি অনন্তকাল নরকে দিবেন যিনি নাকি আবার পরম করুণাময়, অসীম দয়ালু!

কোরানের একটি বাণী,

//এতে সন্দেহ নেই যে, আমার নিদর্শন সমুহের প্রতি যেসব লোক অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করবে, আমি তাদেরকে আগুনে নিক্ষেপ করব। তাদের চামড়াগুলো যখন জ্বলে-পুড়ে যাবে, তখন আবার আমি তা পালটে দেব অন্য চামড়া দিয়ে, যাতে তারা আযাব আস্বাদন করতে থাকে। নিশ্চয়ই আল্লাহ মহাপরাক্রমশালী, হেকমতের অধিকারী।// [সুরা নিসা: ৫৬]

এ মহাবিশ্ব এমন কেউ সৃষ্টি করবেন না যিনি মহান অথচ সৃষ্টির আগেই নরককে রাখবেন তার পরিকল্পনায়। এখন আরেকটি মুমিনীয় প্রশ্ন, তাহলে পরীক্ষা কিভাবে হবে? আসলে মুমিনরা পরকাল-ইশ্বর-অলৌকিকতা এগুলো নিয়ে এত বেশি জানে যে অস্তিত্ববান হলে স্বয়ং ভগবানও জানত না। পরীক্ষা নেয়ার অনেক সভ্য পদ্ধতি আছে। একটি উদাহরণ দেই। যেমন ধরেন ইশ্বর নরক তৈরী করলেন না। যারা নরকে যাবে বলে তিনি জানেন তাদেরও তৈরী করলেন না। ধর্মের ধারণা মতে, ইশ্বরের পক্ষে এমনিতে অসীম সংখ্যক মানুষ তৈরী করা সম্ভব যারা নরকে যাবে, এবং সেটা তৈরী না করাও পুরোপুরি সম্ভব ব্যাপার। যেহেতু ঈশ্বর মহান তাই তিনি এসব পাপীদের তৈরী করলেন না এবং প্রয়োজন নেই বিধায় নরকও তৈরী করলেন না। শাস্তির জন্য আগুনে পোড়ানো, কী ভয়াবহ নৃশংস চিন্তা দেখেন! যাই হোক, ঈশ্বর শুধু স্বর্গ তৈরী করলেন, নিজের অস্তিত্বের পুরো প্রমাণ দিলেন, সত্য ধর্ম দিলেন, এখনই হবে আসল পরীক্ষা। এখন যারা অধিক পরিমাণে ধর্ম মানবে, ইশ্বরকে মানবে তারা অধিক পুরষ্কৃত হবে স্বর্গে, এক নম্বর জান্নাত দেয়া হবে তাদের, আর যারা কম মানবে তাদের নিচের স্তরের গুলো। কী সুন্দর আর মানবিক ‘পরীক্ষা’ সম্ভব! কিন্তু মুমিনদের মাথায় আর তাদের অপরিসীম ক্ষমতা এবং সবজান্তা ভগবানের মাথায় এরকম কোনো পরিকল্পনার উদয় হয় নাই।

সকল ধর্মের মুমিনরা আমার বিস্ময়। তারা কোনো বিচার-বিবেচনা ছাড়াই অনায়াসে বিশ্বাস করে ফেলে তাদের ধর্ম, এমনকি তাদের ধর্মের অনেকগুলো শাখার মধ্যে সে পৈতিকসূত্রে অথবা গুরুসূত্রে যে বিশ্বাস পেয়েছে কেবল সেটাই সত্য, আর সকলেই বিপথে গেছে। আর এদের মধ্যে কেউ কেউ এত বেশি বিশ্বাস করবে যে তাদের ধর্মের সমালোচনা যে করবে তাকে হত্যা করে শান্তির রাজ্য প্রতিষ্ঠার দিবাস্বপ্নে বিভোর হবে। কিন্তু সময় মন্দ, ক্ষমতা দখলের পরেও আফগানিস্তানে সে শান্তির রাজ্য টিকিয়ে রাখা সম্ভব হয় নি বেশিদিন।

৫। ইসলামের শুধুই প্রশংসা করতে হবে, কোন সমালোচনা নয়, নিন্দা নয়। পৃথিবীটাকে আক্ষরিক অর্থেই ‘মামাবাড়ি’ বানিয়ে ফেলেছে মুমিনরা। আপনার ধর্ম সত্য, তাহলে এটা নিয়ে এত ভয় কেন যে এর সমালোচনা/নিন্দা করলে হত্যা করে ফেলতে হবে? কেন এই কাপুরুষোচিত পরাজয়? কলমকে চাপাতি দিয়ে আঘাত করে এবং একে সমর্থন করে আপনারা যে অসভ্যতার নমুনা দেখিয়েছেন সেটা ইতিহাস হয়ে থাকবে।

কোনো ধর্ম/মতবাদ সত্য কিনা তা যাচাই করতে, উপলব্ধি করতে হলে অবশ্যই এমন একটি পরিবেশ বজায় রাখতে হবে যেখানে মুক্তভাবে এর সমালোচনা করা যায়, নিন্দা করা যায়। যদি এই পরিবেশ না থাকে তবে যেকোনো মিথ্যাচারকে ধর্ম হিসাবে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। বর্ণ প্রথার সমালোচনাকে যদি মেনে নেয়া না হয়, সতীদাহ প্রথার নিন্দা করার পরিবেশ না থাকে তবে হিন্দু ধর্মের বর্বর রূপ পুনরায় ফিরে আসবে। একটি ধর্ম সত্য, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হওয়া উচিত এর সমালোচনাকে উৎসাহিত করার মাধ্যমে, ইচ্ছেমত নিন্দা করার উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করার মাধ্যমে, কলমের জবাব কলম দিয়ে দেয়ার মাধ্যমে। নিন্দা করাকে মেনে নেয়া হবে না, শুধুই প্রশংসা করতে হবে এরকম শর্ত আরোপ করলে সকল প্রশংসা স্তুতিতে পর্যবসিত হয়। প্রকৃত প্রশংসা তখনই পাওয়া সম্ভব যখন নিন্দা করার স্বাধীনতা থাকে।

বিশ্বের দেড়শ’ কোটি মুসলমান নবির নামে প্রতিদিন দরুদ পড়ছে, আল্লাহর নাম নিচ্ছে, ধর্মের প্রশংসা করছে সেখানে শ’খানেক মানুষের সমালোচনা যদি একে এমনভাবে ধ্বসিয়ে দেয় যে তাদের উপর আঘাত করে ধর্ম বাচাতে হয় তবে বুঝতে হবে ঐ ধর্মে সমস্যা আছে, এবং তা অত্যন্ত ভয়াবহ।

কেউ কোনো ধর্মের বা মতবাদের নিন্দা করলে আপনার অবারিত স্বাধীনতা আছে এর জবাব কলমের মাধ্যমে দেয়ার। কারো লেখায় অনুভূতিতে আঘাত পেলে সে লেখা না পড়ার, এড়িয়ে যাওয়ার স্বাধীনতা আছে আপনার।

শেষ পর্যন্ত চাপাতি রেখে কলমকেই সম্বল করতে হবে, এটা মধ্যযুগ নয়। আর বাংলাস্তান মানেই সারা বিশ্ব নয়। হত্যা করে প্রলয় থামানো যাবে না।

Niloy