এই লেখাটা আমার গত কয়েক মাসের বেশ অনেকগুলো পর্যবেক্ষণ, ইতস্তত বিক্ষিপ্ত চিন্তা এবং বিশ্লেষণের সংকলন – উগ্র নাস্তিকতা, ভল্টেয়ার লেকচার, অভির গুফিত্ব সহ আরও কিছু ব্যাপার নিয়ে। অভিজিৎ থাকলে এই লেখাটাকে সম্ভবত কতগুলো ‘আপঝাপ’ আজাইরা কথা বলে আখ্যায়িত করতো। খুশী হয়ে বলতো ‘তুমি তো এরকম আপঝাপ লেখা লেখো না, গান কবিতার লাইন উদ্ধৃত কর না, যাক চান্দু, তুমি এতদিনে লাইনে আইছো!’ কথায় কথায় যেখানে সেখানে কেন কবিতা ‘হান্দায়’ দেয় এই জন্য অভির সাথে কত খ্যাচখ্যাচিই না করেছি!

পাঁচ মাস পার হয়ে গেলো, কী অদ্ভুত এক নীরবতায়। এত হৈচৈ, চারদিকে এত মানুষের ভিড়, কিন্তু কী অদ্ভুত এক নীরবতায় ছেয়ে থাকে আমার আরেক সত্ত্বা। অভির এই না থাকাটা চিরজীবনই থাকবে আমার একান্ত হয়ে, কত কিছুই তো আর ফিরে আসবে না – সেই ‘প্যাচপ্যাচানি’ প্রেম চর্চা, চিঠির পর চিঠি লেখা, নিত্যদিনের অভ্যস্ততায় বা ক্ষুদ্রতায় প্রেম কমে গেলে বা হারিয়ে গেলেই আবার নতুন করে ঝালাই করার আপ্রাণ চেষ্টা, ওর সেই অকল্পনীয় রকম উদারতার ছোঁয়া, স্বেচ্ছারিতার দেওয়াল উপড়ে ফেলে ঝগড়া করার আনন্দ, লেখায় ডুবে যাওয়ার ফলে ওর অদ্ভুত সেই উপেক্ষার বিরুদ্ধে অনন্ত সংগ্রাম… সবকিছুই। সে যাক, এ কষ্ট নিয়ে তো পাতার পর পাতা লেখা যায়, কত লক্ষ মানুষও গেছে বা যাচ্ছে এই কষ্টের মধ্য দিয়ে। কাজের কিছু কথায় আসা যাক…

ভল্টেয়ার লেকচার এবং অভির গুফিত্ব

কয়েকদিন আগে মুক্তমনার পক্ষ থেকে ববস এওয়ার্ড নেওয়ার সময়, ভল্টেয়ারের লেকচার দেবার সময় আমার ‘হাসিমুখ’ দেখে কেউ কেউ বেজায় বেজার হয়েছেন জানতে পারলাম। সত্যি বলছি, আমি আসলেই ওনাদের দুঃখটা হৃদয় দিয়েই অনুভব করতে পারছি ইয়ুটিউব ভিডিওটা দেখার পর। ওনাদের কষ্ট হওয়ারই কথা, খুবি যৌক্তিক! একে তো সদ্য বিধবা, ক্যান্সারের হাতে চিরবন্দি, তার উপরে আবার এরকমভাবে অকাল্পনিক নৃশংস হামলার রেশ কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই কেউ কী এরকম হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়তে পারে? জিম আল-খালিলির সাথে পাতানো অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে ইয়ার্কি মারতে পারে? তার উপরে আবার মেয়ে মানুষ, অশ্রুজলে ভেসে যাওয়াই যার বিবর্তনীয় জৈবিক কর্তব্য! কী যে লজ্জার কথা! তবে শুধু ছোট্ট একটা সমস্যা এখানে – এনারা কেউই অভিকে চিনতেন না ভালো করে (ফ্রেন্ড, বেস্ট ফ্রেন্ড শব্দগুলোর অর্থই হয়তো বোঝেন না তারা)। কখনো সময় কাটান নি ওর সাথে সেভাবে। মানুষ অভিজিৎ রায়কে চেনার ‘দুর্ভাগ্য’ তাদের হয়নি। আমার মতো এরকম তারছেড়া একটা মানুষের জন্যও অভিজিৎ রায় ছিল একটা বিশাল বিস্ময়! পারস্পরিক বিস্ময় কাটিয়ে উঠতে উঠতেই কীভাবে যেন আমাদের ১৩ টা বছর পার হয়ে গেলো। কে কতবড় তারছেড়া এবং মিস ফিট সেটা নিয়ে বিতর্ক করতে করতে কত রাত পার করেছি আমরা দুজন। তবে তার ছোটবেলার বন্ধুরা কিন্তু বোঝে। তার এক ছোট্টবেলার স্কুলের বান্ধবী আমার লেকচারটা শেয়ার করে লিখেছে, এই লেকচারটা দেখলে অভিজিৎ কত গর্বিত এবং খুশী হতো সে যেন সেটা চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে! লেকচারটার প্রতিটি শব্দ লেখার সময়, পড়ার সময়, অজস্র মানুষের ভিড়ে চোখের সামনে না থাকা সেই মানুষটিই ছিল শুধু আমার চোখের সামনে দাঁড়িয়ে-

ওই আকাশ-ছাওয়া কাহার চাওয়া, এমন ক’রে লাগে আজি আমার নয়নে…

লেখার সময় প্রতিনিয়ত মনে হয়েছে, অভি থাকলে কিভাবে এটা সমর্থন করতো, ঐটা শুনে কোমর বেঁধে ঝগড়া করতো, কোনটাতে হাহা করে হেসে টিটকারি মারতো, ঘাড় বাঁকিয়ে বলতো, ‘তোমার লেকচার, তোমার স্বাধীনতা, আল্লায় চোপা একখান দিছে, বইলা নাও যা বলতে চাও, আমি আর কী কমু…’

আর যারা আসলেই অভিজিৎকে আসলেই সত্যিকারের বন্ধু বলে মনে করেছেন তারা এই চরম দুঃসময়ে এগিয়ে এসেছেন, সহমর্মিতা জানিয়েছেন, মুক্তমনার সাথে সংহতি প্রকাশ করেছেন, আমাদের বিভিন্নভাবে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন। পরিচিত অপরিচিত সুহৃদদের সহমর্মিতায় এতটাই ধন্য হয়েছি যে কাগজে কলমে সেই কৃতজ্ঞতা জানিয়ে শেষ করা যাবে না।

আসলে যে কেউই তো যে কোনো কিছুতে আপত্তি জানানোর অধিকার রাখেন। এতে রাগ করার কী আছে? জনসমক্ষে গিয়ে আমি কোন বক্তৃতা দিলে তা নিয়ে গণ-সমালোচনা করার অধিকার যে কারো আছে। বাক-স্বাধীনতা নিয়ে বড় বড় কথা বলবো, আর আমার হুদাহুদি-হাসিমুখের ছবি দেখে কেউ সমালোচনা করলে গাল ফুলাবো তা তো হতে পারে না। শুনলাম আমার নাকি মনে রাখা উচিত, আমি আর অভিজিতের ঘরে নেই। বড় বড় বিশ্বমঞ্চে উপস্থিতির তাৎপর্য বোঝা উচিত এখন আমার! হুম, তাইই সই, যে যা ইচ্ছে তো বলতেই পারেন। তবে এসব শুনলে আমার হাসি আসে অন্য কারণে (হ্যাঁ অভিজিৎ এবং আমি একটু অতিরিক্তই হাসতাম, সবকিছু নিয়েই হাসাহাসি করতাম – আমার ক্যান্সারে অকালে মারা যাওয়ার সম্ভাবনা, ওর ভুড়ি, হাই-কোলেস্টেরল, ফালতু ফারাবির থ্রেট, সবকিছুই। আমরা দুজন দুজনার সীমাবদ্ধতা বা দার্শনিক ভণ্ডামি নিয়ে কত যে হেসেছি তা কেউ কল্পনাও করতে পারবে না। আমি আরো বেশি কেন হাসি না সেটা নিয়েই ছিল অভিজিতের কমপ্লেইন!) আমি, মানে ব্যক্তি আমি, কোনদিনো অভিজিতের ঘরে ছিলাম না, অভিজিৎ এবং আমি কেউই আসলে কারো ঘরে ছিলাম না। আমরা দুজন দুজনার ‘খোলা হাওয়া লাগিয়ে পালে’ ডুবতে রাজি হয়েছিলাম। ঘর, বিয়ে, সমাজ, রাষ্ট্র, ধর্ম এসবের মধ্যে বাস করেও এদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে ছিলাম আমরা। অনেকেই হয়তো বলবেন, আমরা ‘ডিনায়েল’ এ থাকি। বলুন না, ক্ষতি কী! আর কর্মসূত্রে আমাকে তথাকথিত ‘বড় বড়’ মঞ্চে (এধরণের পাবলিক স্পিকিং না হলেও, কর্পোরেট জগতের আন্তর্জাতিক মিটিং তো হরহামেশাই করতে হতো) মাঝে মাঝেই হাজিরা দিতে হতো এমনিতেই, অনেক আগে থেকেই। হঠাৎ করে কেউ আমাকে ছক্কা মেরে ব্ল্যাক জ্যাকের টেবিলে ছুঁড়ে দেয় নি। আমি জীবনে যতটুকু স্বাধীনতা উপভোগ করেছি, অভিজিতের সাথে থাকার আগে, সময়ে এবং পরে, অনেক ছোটবেলা থেকেই, তা আসলে বেশিরভাগ মানুষ কল্পনাও করতে পারে না। আর সেখানেই ছিল অভি আর আমার সম্পর্কের ভিত্তি, পারস্পরিক শ্রদ্ধা, স্বাধীনতা এবং ঝগড়া-ভালোবাসার দেওয়ালবিহীন এক অদ্ভুত গণ্ডি। এটা কাউকে বোঝানোর ইচ্ছাও আমার নেই। তাকে ঔদ্ধত্য বললে তাইই সই, এই ‘গুণ’টার অভাবতো কোনদিনও ছিল না আমাদের দুজনেরই।

গুফি বললে অভিজিতের মতো মানুষের কখনোই অপমান হয় না, কারণ আসলেই সে শুধু গুফিই নয় চরম গুফি ছিল(শব্দটার কলোক্যুয়াল ব্যবহার হয়তো কারো কারো অজানা)। তার মতো সদাসুখী এবং সদাগুফি মানুষ খুব কমই হয়। সে আর আমাদের মেয়ে ছিল এক দলে আর আমি ছিলাম তাদের চির শত্রু অন্যদল। আমার দোষ? আমি তাদের বাস্তব জীবনে ফিরে আসতে বলতাম মাঝে মাঝে। তৃষার বেগুনি রঙটা খুব পছন্দ ছিল বলে ওর নাম দিয়েছিল তিসু ঘিষু পারপেলি বেলাকুলা, ডিম্বহাম্বে বানাতো উইকেন্ডে সকালে উঠে (হ্যাঁ ঠিক ধরেছেন, অভিজিৎ ডিমকে ডাকতো ডিম্বহাম্বে, কেন জিজ্ঞেস করবেন না প্লিজ), অভিজিৎ একটু মোটা ছিল বলে ও ছোট্ট তৃষাকে শিখিয়েছিল ওকে ‘ভুটুস’ ডাকতে। সুযোগ পেলেই সারা বাড়ি জুড়ে পেঙ্গুইনের মতো করে হাঁটতো দুজনে পায়ে পা রেখে, নিয়মিত ব্যায়াম করা নিয়ে আমার সাথে দুজন দুজনের পক্ষ হয়ে আপিল করতো, ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন নিয়ে গান বানিয়ে বেসুরো ভাবে জোড়ে গেয়ে উঠতো, একজন আরেকজনের গানে বাংলিশ কথা এবং সুর বসাতো, অদ্ভুত অদ্ভুত মুখ করে ছবি তুলতো..। অভিজিৎ ওকে শিখিয়েছিল যে তার মা ঠিকমত বাংলাভাষাটাও জানে না। তৃষা এখনো সেটাই বিশ্বাস করে :)। অভিজিৎ কার কত ‘প্রিয়’ বা কাছের ছিল সেটা নিয়ে আমার মাথাব্যথার তো কোন কারণ নেই! কারণ আমাদের দুজনের ‘প্রিয়ত্বের’ পরিমাপটা বড্ডই অন্য ধরণের ছিল।

এমনিতেই তো এই ছোট্ট পৃথিবীটার যাচ্ছেতা অবস্থা করে ছেড়েছি আমরা ২ লক্ষ বছরের এই দ্বিপদী অস্তিত্বের ভারে। সবাইকে অনুরোধ করবো, যারা বলছেন তাদের বলে যেতে দিন, একদিন তো থামতেই হবে সবাইকেই। শুরু হওয়াটা অনেক সময়ে ‘চান্সে’র উপর নির্ভর করলেও শেষ হওয়াটা কিন্তু করেনা। অনেক মূল্য দিয়ে শিখেছি যে সবকিছুই শেষ হয়ে যায় একদিন। আমাদের কাছের মানুষদের কাছে অনুরোধ, এ নিয়ে আর লেখালিখি করে কী বোর্ডের অপচয় করবেন না প্লিজ। যারা ফেসবুকে চটকদার স্ট্যাটাস দিয়ে পৃথিবীর নোংরামির কার্বন ফুটপ্রিন্ট বাড়াতে চায় তাদের সেই অধিকার থেকে বঞ্চিত করার চেষ্টা করে কী লাভ। শুধু বলবো ‘সময় যদি ফুরিয়ে থাকে হেসে বিদায় কর তাকে…’

ব্লগারদের সহায়তার জন্য টাকা তোলা প্রসঙ্গে

আরেকটা বিষয় নিয়ে কথা বলতে চরম অস্বস্তি হয়, তারপরো বলছি, অনেকেই জানতে চেয়েছেন বলে। শুনেছি টাকা তোলা হয়েছে ব্লগারদের সহায়তা করার জন্য। এটা নিয়েও নাকি হইচই হচ্ছে অনেক। কেউ যদি টাকা তুলে থাকে কোন কারণে সেটা নিয়ে আমাদের রাগারাগি করার কী আছে সেটাই আমার বোধগম্য নয়। আমি সব আন্তর্জাতিক হিউম্যানিস্ট সংগঠনকে জানিয়ে রেখেছি যে, মুক্তমনা, জীবিত, মৃত বা অর্ধমৃত অভিজিৎ বা অভিজিতের পরিবারের কারোরই অর্থ সাহায্যের দরকার নেই এখন। আর্থিক, কারিগরি, বৈষয়িক কোনটাই নয়। কোনদিন যদি লাগে তাহলে ঘোষণা দিয়েই জানাবো। আপাতত মুক্তমনার অভ্যন্তরীণ গ্রুপটার বাইরে যাওয়ার দরকার হবে না আমাদের আশা করি। আসিফ মহিউদ্দিন যখন আমাকে সেই টাকা তোলার বিষয়টা জানিয়েছিলেন তখন বোধ হয় একটা কথাই বলেছিলাম ওনাকে, অভিজিৎ বা মুক্তমনা বা আমাদের কারো নাম যদি এর সাথে সংশ্লিষ্ট না থাকে তাহলেই আমরা খুশি। আমাদের দরকার নেই, তাই বলে কী অন্য কারো দরকার হতে পারেনা? টাকা যার দরকার তার হাতে যাওয়াটাই তো সবার জন্য ‘মঙ্গল’।

আমি যেহেতু ফেসবুক নিয়মিত ফলো করি না তাই অনেক কিছুই জানতে পারি না বা দেরিতে জানি অনেক সময়েই। আগে অভিজিতের কাছ থেকে আমি এগুলোর খবর পেতাম মাঝে মাঝে, এখন অন্যান্য মানুষজন অনলাইন মাধ্যমে এসবের লিঙ্ক না পাঠালে (এবং ভুল করে আমি সেগুলোতে ক্লিক না করে ফেললে) আমি এগুলোর খবরও পাইনা। সেহেতু বলবো, যার যা ইচ্ছা লিখুক, আমাকে বা অভিজিৎকে নিয়ে তাতে কিচ্ছু এসে যায় না। কারণ আমি সাধারণত এগুলোর খবর রাখিনা এবং যদি জেনেও ফেলি, সব সময় সফল না হলেও, বেশীরভাগ সময়েই তা নিয়ে বিব্রত না হওয়ারই চেষ্টা করি।

মুক্তমনাদের জন্য একটাই অনুরোধ। ধর্মনিরপেক্ষ, মানবতাবাদী বিশ্ব গড়ায় আমাদের, অভিজিতের, ওয়াশিকুর বাবু, রাজীব হায়দার, অনন্তর সংগ্রামের কথা ভুলে যাবেন না। যেই সংগ্রামের কথা নিয়ে নীচে বিস্তারিত আলোচনা করারো ইচ্ছা রইলো। ওয়েব মার্কেটিং জগতে একটা প্রিয় কথা আছে, ‘don’t just drive clicks, drive Market share’। সেরকমই, লাইকের পিছনে না ছুটে, নিজের এবং অন্যদের দৃষ্টি অনেকদূর প্রসারিত হয় এমন কিছু করাতে নিবিষ্ট হোন, এ জীবনে হাজার হাজার লাইক না হয় নাই জুটলো! জঁ-পল সার্ত্র’র ভাষায় বললে বলতে হয়, ‘One is still what one is going to cease to be and already what one is going to become. One lives one’s death, one dies one’s life.’

উগ্র নাস্তিকতা বনাম ভদ্র নাস্তিকতা এবং বাক্-স্বাধীনতা

মুক্তমনার বেশ কিছু মডারেশন পলিসির কারনে উগ্র নাস্তিকতা বনাম ভদ্র নাস্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এটা নিয়ে আমি এখানে আমার ব্যক্তিগত মতামতটা রাখতে চাই। সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে আমি এখানে যা বলছি তা শুধু আমার নিজেরই মত, আমি শুধুই একজন মুক্তমনার ব্লগার হিসেবে বলছি। অভিজিৎ থাকতে সে যা বলতো সেটাই অনেক সময় মুক্তমনার বক্তব্য হিসেবে হয়তো ধরা হতো, কিন্তু তারপরেও ওগুলো নিয়ে কিন্তু বহু তর্ক বিতর্কও হতো। এখন মুক্তমনা তার সম্পাদকমণ্ডলী এবং উপদেষ্টাদলের সম্মিলিত উদ্যোগে চলে। কোন ব্লগারের অধিকার নেই ব্যক্তিগতভাবে বা সোশ্যাল মিডিয়ায় গিয়ে মুক্তমনার অবস্থান নিয়ে কথা বলার। আমারো নেই, ফরিদ ভাইয়েরও নেই, অন্য সম্পাদকদেরও নেই, আর অভিজিৎ কোন পারগেটরি বা অন্য ডায়মেনশন থেকে সে চেষ্টা চালালেও তার সে দাবী এখন বোধ হয় খারিজ করে দেওয়া হবে।

‘উগ্র’ নাস্তিকতা সম্পর্কে বলার আগে কিছু ব্যাপার উল্লেখ করতে চাই। ফরিদ আহমেদকে নিয়ে সম্ভবত অনেকেই অনেক কিছু লিখেছেন সোশ্যাল মিডিয়ায় ইদানিংকালে। উনি দীর্ঘদিন ধরে আমাদের সাথে কাজ করে আসছেন মুক্তমনায়। ২০১২ সাল থেকে উনি মুক্তমনার মডারেশনে না থাকলেও ২৬ শে ফেব্রুয়ারিতে অভি ও আমার উপরে হামলার পরে উনি যেভাবে এগিয়ে এসে মুক্তমনার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন, অন্যান্য মডারেটরদের সহযোগিতা করেছেন মুক্তমনাকে টিকিয়ে রাখতে, সেজন্য তার কাছে কৃতজ্ঞতার সীমা পরিসীমা নেই। এর পরের তিনটা মাস ছিল বিভীষিকাময়, সবদিক থেকেই। আমি তো কোনকিছুর খোঁজখবর নিতে পারিই নি, বরং এক আইসিইউ থেকে আরেক আইসিইউতে টানাহ্যাচড়ার মধ্যেই ছিলাম। সে সময় হাসপাতালে, তারপর চলেছে বাসা থেকে চিকিৎসা দীর্ঘদিন। আমার পরিবার এবং কয়েকজন ঘনিষ্ট বন্ধু তখন যেভাবে আমার দেখাশোনার দায়িত্ব নিয়েছিলেন তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। দুঃখ একটাই, এখনো আমার বাবা মা আমারই দেখাশোনা করে চলেছেন, এ বয়সে এসে সেটা উলটে যাওয়ার কথা ছিল, সেটা আর করা হল না।

সে যাক, প্রাসঙ্গিকভাবেই এবার একটু ২০১৩ সালের দিকে তাকাই। অন্ধকারের নিমজ্জিত যে কোন ধর্মীয় জঙ্গী বা ইসলামী জঙ্গীদের কাছে অভিজিৎ, অনন্তর মতো নাস্তিক, মানবতাবাদী, বিজ্ঞানমনষ্ক আলোকিত মানুষেরা চিরশত্রু বলে গণ্য হবে সেটা বলাই বাহুল্য। মুক্তমনা, যার লক্ষ্য কিনা বিজ্ঞান-যুক্তি-মানবতাবাদ প্রসারে কাজ করা সেটা ধর্মান্ধ, বোধবুদ্ধিহীন, চেতনাহীন, মনুষ্যত্বহীন একজনের শত্রু হবে সেটা বুঝতে রকেট সায়েন্টিস্ট হওয়া লাগে না। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও সর্বোচ্চ শাস্তির দাবীকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা শাহবাগ আন্দোলনের তীব্র জনসমর্থনে ভয় পেয়েছে কারা? যারা ভয় পেয়েছে তারা মানবতাবিরোধী অপরাধীদের অপরাধের সমর্থক, তারা মানুষের মৌলিক অধিকারের বিপক্ষে, বিপক্ষে স্বনির্ভর ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের। শাহবাগ আন্দোলনের স্বতস্ফূর্ততা তাদের ভয় পাইয়ে দিয়েছিলো। তাদের যখন দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যায় তখন তারা কী করে সেইটার উদাহরণ তো আমরা অনেকই দেখেছি। তার উদাহরণ আমাদের মুক্তিযুদ্ধ প্রাণ দেওয়া ত্রিশ লক্ষ মানুষ, উদাহরণ গণিমতের মাল হিসেবে চিন্থিত আমাদের ধর্ষিত মা-বোনেরা, উদাহরণ মাথায় গুলি খেয়ে রায়েরবাজারে পড়ে থাকা আমাদের বুদ্ধিজীবিরা। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সব সমস্যাকে আড়াল করতে তখনও ধর্ম গেলো, ধর্ম গেলো জিকির তুলে আমাদের উপর আক্রমণ করা হয়েছে ‘শান্তি’র তরবারি দিয়ে। ২০১৩ সালেও শাহবাগের সেই আন্দোলনকে ভিন্ন দিকে নিতে হলে ধর্মের কার্ড ছাড়া আর কি বা ছিল তাদের হাতে? ধর্মানুভূতি নামক এক আজব বিতর্কের অজুহাতে আন্দোলনকে বিতর্কিত করার ইচ্ছা থেকেই এই ধর্মান্ধ প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি যখন ব্লগার রাজীব হায়দারকে হত্যা করলো তখন পরিকল্পনা মোতাবেক তারা পত্রিকা ফেসবুকে সব জায়গায় রব তুললো- নাস্তিকরাই সব অপকর্মের মূলে, এদের হত্যা করা জায়েজ! এই রব তোলার জন্য তো ওরা প্রস্তুতই ছিলো। কিন্তু আমরা এতো সহজে টোপে পা দিলাম কী করে? থাবা বাবারা যা ইচ্ছা লিখুক। শুধু লেখার অপরাধে একজন মানুষকে তার নিজের বাসার সামনে কুপিয়ে হত্যা করা জায়েজ হয়ে গেছে কোন সভ্যতায়? যারা রাজীবকে নৃসংসভাবে হত্যার পর, রাজীবের অপরাধের লিস্টি করেছেন তাদের বর্ণনা তো দিলামই। কিন্তু সবচেয়ে অবাক হই যখন আমরা নিজেরাই শত্রু বানিয়ে ফেলি স্বয়ং রাজীবকেই। অনেকে আরও এক কাঠি সরেস, তারা দাবী করলেন – থাবা বাবা এসব লেখেই নাই। তার মানে কী এমন লেখা কেউ লিখলে তাকে মেরে ফেলাই যায়? শত্রুর এতো চেনা চালে এমন সহজে বিভ্রান্ত হয়ে গেলাম আমরা?

অনন্ত-অভিজিৎ দের অপরাধ কী ছিল? বিজ্ঞান নিয়ে লিখতে ভালোবাসতো তারা, নাস্তিকতা, মানবতাবাদ, ধর্মনিরেপক্ষতা নিয়ে প্রচন্ড সোচ্চারও ছিলো, সোচ্চার ছিলো মানুষের যেমন ইচ্ছা ভাব প্রকাশের অধিকারের জন্য। রাজীবকে যারা উগ্র নাস্তিক বলে পরোক্ষভাবে হত্যাকাণ্ড জায়েজ করেছেন তাদের দৃষ্টিতে অভিজিৎ কি? ফারাবীর চোখে অভিজিৎও উগ্র নাস্তিক। যদিও অভিজিৎ ভাবতো বিজ্ঞান, দর্শন, সাহিত্য, মানব ইতিহাস নিয়ে সেই ওকেও অভিযুক্ত করা হলো নবীকে ব্যঙ্গ করার দায়ে! অভিজিতের দোষ নবী কে ব্যাঙ্গ করা ছিলো – এরচেয়ে হাস্যকর আর কিছুই হতে পারে না। ওর দোষ যদি থেকেই থাকে সেইটা ছিলো ওর বিজ্ঞানের কথা বলা, যুক্তিবাদের কথা বলা, ওর দোষ ছিলো অনন্তর ভাষায় বলতে গেলে বলতে হয়—‘অভিজিতের দোষ ছিলো আগামী দিনের জাত-প্রথা-ধর্ম-বর্ণ-শ্রেনী বৈষম্যমুক্ত বিশ্ব তৈরির শুভজোয়ারকে প্রেরণা জোগানো, মানুষকে সেই শুভ জোয়ারের সাথে সম্পৃক্ত করা।’ অভিজিতের ‘দোষ’ অনন্ত ছাড়া আর কে ভালো বুঝবে, একই দোষে সেও তো ‘দোষী’। অভিজিতের মৃত্যুর পর অভিজিৎ এমন লিখলো কেনো, এই ব্যবসা আর জমলো না। ব্যাঙ্গ- ফ্যাঙ্গতো সে করতোই, অত্যন্ত বুদ্ধিদীপ্ত এবং কড়াভাবে ‘উগ্র’ ভাষাতেই করতো। কিন্তু তার আসল কাজগুলোতো এত্তগুলো বই আকারে সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, কি আর করা! ও লিখেছে বিজ্ঞানের বই, দর্শনের বই, সাহিত্যের বই সেসব লেখার স্ক্রিন শট দিয়ে ব্যবসা আর জমে কিভাবে! তাছাড়া রাজীবকে মুসলমান বানিয়ে দেওয়া গেছে রাজীবের সকল চিন্তাভাবনাকে সরাসরি অপমান করে, যে চিন্তাভাবনার জন্য একমাত্র জীবনটা হারালো সে। বাবুকে যারা মেরেছে তারা ব্লগ কী তাই জানেনা, জানেনা কেন কুপাচ্ছে একজন মানুষকে। অভিজিতের বলা সেই বিশ্বাসের ভাইরাসে তাদের মাথা এতটাই আক্রান্ত যে তারা মাদ্রাসার শিক্ষকের আদেশেই অন্ধভাবে দুইপায়ে মানুষ মারতে খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে যায়।

সে যাক, এবার ফরিদ ভাইয়ের কথায় আবার ফেরত আসি। সে সময়, ফরিদ ভাই এবং মুক্তমনার অন্যান্য মডারেটর এবং শুভাকাঙ্খীরা এগিয়ে এসে মুক্তমনার সব কাজতো করেছেনই, তার উপর আবার আমাকে দিনের পর দিন সান্ত্বনা দিয়েছেন। বলেছেন চিন্তা না করতে, ওনারা মুক্তমনার জন্য নিঃস্বার্থভাবেই কাজ করে যাবেন। তবে সে সময়ের মডারেশনের সিদ্ধান্তগুলো খুব সোজা ছিল না। রাজিব হত্যার পর থেকে চেনা-অচেনা ব্লগার, লেখক, একটিভিস্টরা জীবনের হুমকি খাচ্ছিলেন, শিকারের মতো করে তাদের তাড়া করে বেড়াচ্ছিল মৌলবাদী সন্ত্রাসীরা। একদিকে মুক্তমনাদের মাথার দাবী তোলা হচ্ছে আরেকদিকে সরকার তাদের খুঁজছে ওয়ারেন্ট হাতে, জেলে পুরতে। তারপর এবছর একের পর এক ব্লগারের মৃত্যু, বিশেষ করে অভিজিতের পর অনন্তের মতো মুক্তমনার এত কাছের আরেকজনের হত্যার পর অদ্ভুত এক জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল।

মানছি যে, সে সময়ে ফরিদ ভাই এমন কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবং বক্তব্য রেখেছেন যা নিয়ে অনেক বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে। তবে প্রথমেই এটা উল্লেখ করে নিতে চাই যে সেগুলো উনি একার সিদ্ধান্তে করেন নি, মুক্তমনার তখনকার মডারেশন টিমও(আমি সহ) সেটার সাথে জড়িত ছিলো, তারা নিজেরাও এটা নিয়ে বির্তক করেছে নিজেদের মধ্যে। এরকম ক্রিটিকাল একটা সময়ে বড় কিছু ভুল ত্রুটি হতেই পারে, বিশেষ করে যিনি গণসমক্ষে উপস্থিত তার পক্ষে। সে সময়ে উনি ব্যক্তিগত বেশ কিছু মন্তব্য করেছিলেন মুক্তমনার মডারেটর হিসেবে ব্লগে এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় যেগুলোর কারণে অভিজিত এবং মুক্তমনার অবস্থান নিয়েই সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে। লেখক এবং ব্লগার হিসেবে ফরিদ ভাই অনেক কিছুই বলতে পারেন, সেটা ওনার স্বাধীনতা। কিন্তু তিনি যখন মুক্তমনার মডারেটর হিসেবে বলেন যে, অভির মৃত্যুর জন্য অভির লেখালিখি বা কাজ দায়ী নয় বরং উগ্র নাস্তিক এবং ছদ্ম নাস্তিকদের কুৎসিত ফেসবুক স্ট্যাটাস বা লড়াইই দায়ী তখন অনেক ভালো উদ্দেশ্য থাকা সত্ত্বেও বেশ বড় রকমের একটা ভুল হয়ে যায়। আমার মতে, তখন আমরা বড় প্রেক্ষাপটটা ভুলে গিয়ে তাৎক্ষনিক স্ট্রাটেজির বেড়াজালে আটকে যাই। আমাদের মূল আদর্শগত অবস্থান থেকে বিচ্যুত হয়ে যাই। অভিজিৎ-অনন্তরা কিসের জন্য লড়াই করছে, জীবন দিচ্ছে তা ভুলে গিয়ে তাদের হারানোর শোকে বিহবল হয়ে গন্তব্যের দিশা হারিয়ে ফেলি। অভিজিতের ভাষায় বলতে গেলে বলতে হয়, ভীত হবেন না, শোকে দুঃখে ভেঙ্গে পড়বেন না-

যারা কলমের শক্তিতে ভীত হয়ে মত প্রকাশের স্বাধীনতা রুদ্ধ করতে চাচ্ছেন, যারা ‘মসির চেয়ে অসি বড়’ মনে করে ভাবছেন, মুক্তচিন্তার আন্দোলনকে স্তব্ধ করা যাবে, তাদের জন্য করুণা হচ্ছে। যতবার আমরা আহত হব, তত দ্বিগুন শক্তিতে আমরা ফিরে আসব, দাবানলের মতই গ্রাস করে ফেলব চারিদিক। প্লাবনে ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যাবে প্রতিক্রিয়াশীলতার অন্ধচোরাগলি।

আমি মুক্তমনার মডারেশন টিমকে আহবান জানাবো এ সম্পর্কে তাদের অবস্থান পরিষ্কার করে একটা সুনির্দিষ্ট বক্তব্য দিতে।

এবার আসি উগ্র নাস্তিকতা সম্পর্কে আমার মতামতে। লিখতে বসে অভিজিতের পুরোনো কিছু ব্লগ পড়তে পড়তে মনে হল, আমার আর নতুন করে বলার বা লেখার কী আছে। অনেক কিছুতেই দ্বিমত থাকলেও এ ব্যাপারে তো আমাদের কোন দ্বিমত ছিলনা। চলুন দেখা যাক অভিজিৎ তার অভিজিৎ-মার্কা ভাষায় কি বলতো এটা নিয়ে (ভাষাটা একটু আঘাত-প্রোণ্,কিন্তু এটাই গুফি অভিজিতের ভাষা, কারো ভাষানুভূতি দুর্বল হলে অনুরোধ করবো এখানেই পড়া খ্যামা দিয়ে এক কাপ চা খেতে… )

চারিদিকে মুক্তচিন্তার ব্লগাররা আক্রান্ত হচ্ছেন। প্রথমে আসিফ মহিউদ্দীন ছুরিকাহত হলেন, থাবা বাবাকে জবাই করা হল, এর পর আক্রান্ত হলেন সামিউর। সাধারণতঃ যারা আক্রান্ত হন,জনসহানুভূতি কিছুটা হলেও তাদের পক্ষে থাকে। কিন্তু সেটা হবে না যদি আপনি ‘নাস্তিক ব্লগার’ হিসেবে ট্যাগ খেয়ে যান। ধর্মান্ধরা নাস্তিকদের পছন্দ করবে না জানা কথা। কিন্তু মানবতার বাণী কপচানো, সংখ্যালঘুদের জন্য অন্তপ্রাণ, গলা কাঁপিয়ে ‘টক শো’ করা ‘পুলিশ প্রোটেকশন’ নিয়ে চলা সেলিব্রেটি ব্লগাররাও দেখবেন চামের উপ্রে বামে গালি দিয়ে যাবে – ‘ব্যাটা তুই নাস্তিক হইছস ক্যান!ধর্মের বিরুদ্ধে লেখস ক্যান,দোষ তো তোরই। গলায় তুই কোপ খাইবি না তো খাইবো টা কে?’। টিপিকাল ‘women raped, women blamed’ অ্যাটিচুড। বেডি তুই উগ্র পোষাক পড়ছস ক্যান,হ্যাল হ্যাল কইরা চলছস ক্যান, ছিনালী হাসি হাসছস ক্যান। তুই ঠাপ খাবি না তো খাইবো কে!

ওয়েল, চামে চামে ‘চিপায় পড়া আর চিপা খোঁজা’ এইসব সনাতন মানসিকতার লোকজন নাকি নতুন প্রজন্মের সৈনিক, দেশকে নতুন দিশা দেখাবে। দিশার ঠেলায় দিশাহারা অবস্থা আমাগো। ধর্ষিতা নারীদের মতোই। একবার ফিজিকালি ধর্ষিতা হয়, তারপর যখন সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা আঙ্গুল তুলে বলে – ‘ঐ পোশাক পইড়া গেছিল বইলাই না হইছে’। এইভাবে দ্বিতীয়বার হয় আরেকদফা ধর্ষণ। নাস্তিকেরাও তাই। গলায় খায় কোপ একবার। তারপর আসে আরো বড় কোপ – ১৫০০ লাইক আর ছয়শ শেয়ার হওয়া ‘চিপা খোঁজা’ সেলিব্রিটি ব্লগারদের স্ট্যাটাসের কোপ।

আমি কিংবা অভিজিৎ দুজনেই মনে করি মানুষের পূর্ণ বাক্-স্বাধীনতা থাকা উচিত। ধর্মের পক্ষে বা বিপক্ষে, যে কোন কিছুর পক্ষে বা বিপক্ষে। আপনার যদি তাদের ধর্মানুভূতি বা অন্য যেকোন সংবেদনশীল অনুভূতিতে আঘাত লাগে তবে তা ডিফেন্ড করুন, সাহস বা যোগ্যতা থাকলে লেখার জবাব দিন লেখা দিয়ে, অথবা নিজের উন্নত মস্তিষ্কটিতে নিয়ন্ত্রণের কাজে নিয়োজিত যে নিউরনগুলো আছে ওগুলো ব্যবহার করে ঐসব ওয়েবসাইটে, ব্লগে বা পেজে যাওয়া বন্ধ করে দিন অথবা একা একা নিজেই নিজের ঘরে কিছু ছুঁড়ে মেরে রাগ কমান। আমরা শার্লি হেব্দো বা উইকিলিক্স কেন, যে কোন মত প্রকাশের অধিকারকেই সমর্থন জানাবো। প্রথমে তাদের মত প্রকাশের অধিকারের পক্ষে দাঁড়াবো তারপর তাদের শৈল্পিক মান বা দক্ষতা নিয়ে অথবা মুক্তমনায় প্রকাশযোগ্য না অযোগ্য তা নিয়ে আলোচনা সমালোচনা করার প্রশ্ন আসবে। লেখার জবাব যেকোন লেখা দিয়ে দিলে তাকেও সাদরে সমর্থন জানাবো। যতক্ষণ পর্যন্ত না কারো ‘ক্ষতি’ করা হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা বাক্-স্বাধীনতার অধিকারকে ডিফেন্ড করে যাবো।

চলুন এ প্রসঙ্গে স্টুয়ার্ট মিলের হার্ম প্রিন্সিপাল বা ক্ষতি-নীতিটায় একবার চোখ বুলিয়ে নেই। আমি এবং অভিজিৎ এবং সম্ভবত মুক্তমনার সম্পাদকমণ্ডলীও মিলের ‘On Liberty’ বইতে বলা বাক-স্বাধীনতার সীমার সাথে একমত পোষণ করি। জন স্টুয়ার্ট মিল বলছেন, “প্রত্যেকের নিজ মত ব্যক্ত করার পূর্ণ স্বাধীনতা আছে, তা সেই মত যা-ই হোক না কেন; একজন বাদে পৃথিবীর বাকি সবাই যদি এক মতের অনুসারী হয় তারপরও সেই একজনকে তার মত প্রকাশ করতে দিতে হবে, একজনের পৃথিবীর বাকি সবাইকে নীরব করা যতটা অনৈতিক, বাকি সবার জন্য একজনকে নীরব করাও ততটাই অনৈতিক।” বাক্‌-স্বাধীনতা খর্ব করার একমাত্র অধিকার থাকতে পারে একটি সমাজের সংবিধিবদ্ধ কর্তৃপক্ষের এবং তারা কাউকে মত প্রকাশে কেবল তখনই বাধা দিতে পারে যখন সেই মত অন্য কারো “অবৈধ-সরাসরি-ক্ষতির” কারণ হতে পারে। তবে আমি এখানে এটাও পরিষ্কার করে নিতে চাই যে, রাষ্ট্র জনগনের কতটুকু স্বাধীনতা খর্ব করবে তা টেন কমেন্ডমেন্টসের মত কোন পাথরে খোদাই করা স্থায়ী বা সুনির্দিষ্ট ব্যাপার নয়। একটা নির্দিষ্ট জাতির বা দেশের বা সংস্কৃতির পরিপক্কতা, প্রেক্ষাপট, ইতিহাস এবং কালের উপর তা নির্ভরশীল সম্পূর্ণভাবে। এটা গতিশীল, সদা পরিবর্তনীয় একটা কন্সেপ্ট। সেজন্যই আমরা যুগে যুগে জনগনকে দেখেছি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অধিকার আন্দোলনের সংগ্রাম করতে।

এখানে “অবৈধ-সরাসরি-ক্ষতি” বলতে এমন কিছু বুঝাচ্ছি যার কারণে কার্যত কোনো ধরণের সুস্থ বাক্‌-স্বাধীনতাই খর্ব হতে পারেনা। স্ট্যানফোর্ড এন্সাইক্লোপিডিয়া অফ ফিলোসফি থেকে একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। আমাদের বাক-স্বাধীনতা এবং কর্ম-স্বাধীনতার মধ্যে পার্থক্য করতে পারতে হবে। যেমন ধরুন মোটর সাইকেলে চড়ে বাইকাররা এমন কিছু আপত্তিকর কাজ করেন যা জনগনের স্বার্থের বিরুদ্ধে যায়, তাদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়। এখন সরকার যদি সেটা বন্ধ করতে চায় তাহলে তারা মোটর সাইকেল বানানোই বন্ধ করে দিতে পারে তা রোধ করার জন্য। এমনকি তারা বাজারে বা রাস্তায় যেসব মোটরসাইকেল আছে সেগুলো ধ্বংসও করে দিতে পারে। কিন্তু সরকার কি আমাদের কথা বলার অধিকারকে কেড়ে নিতে পারে? কথাটা বলার পরেই তারা শুধু আমাদের টুটি চেপে ধরে কোন শাস্তির ব্যবস্থা করতে পারে, যেমন বাংলাদেশ সরকার করেছিল চারজন ‘নাস্তিক’ ব্লগারকে গ্রেফতার করে। তার অর্থ হচ্ছে আমরা আসলে কথা বলায় স্বাধী্‌ন, তবে সমাজে বাস করতে হলে যে কোন কাজ হুটহাট করে ফেলার তেমন স্বাধীনতা আমাদের নাও থাকতে পারে। এখানে সরকারকে কথা বন্ধ করতে হলে মোটর সাইকেলের মত আমাদের কন্ঠনালী উপড়ে ফেলতে হবে। সেটা যেহেতু সম্ভব নয় সেহেতু কথা বলার অধিকার কেড়ে নেওয়ারো ক্ষমতা কারো নেই।

এখন “অবৈধ-সরাসরি-ক্ষতি”-র ধারণায় ফেরত যাই আবার। যেমন ধরুন আপনি এমন কিছু লিখতেই পারেন যার ফলে দেশের কোন ব্যক্তি বা সরকার আমাকে আদালতে নিয়ে যেতে পারে, সেখানে আমার বিচার হতে পারে, শাস্তি হতে পারে। তবে আপনি এমন কিছু লিখতে বা বলতে পারেন না যার সরাসরি ফলস্বরূপ কেউ আল্লাহু আকবার বা জয় বাবা বলে চাপাতি নিয়ে আমার উপর হামলা করে আমার জীবন নাশ করতে পারে বা আমার বাড়িতে হামলা করতে পারে বা আমাকে আহত করতে পারে। এখন প্রশ্ন হলো ধর্মের যেকোনো রকমের সমালোচনাকে এই “অবৈধ-সরাসরি-ক্ষতি” এর কাতারে ফেলা যায় কি না। উত্তর হলো কোনোভাবেই যায় না। এমনকি অবৈধ তো দূরের কথা ধর্মের যাদৃচ্ছিক সমালোচনা বা ব্যঙ্গ প্রায় কখনোই কারো সরাসরি ক্ষতিরও কারণ হতে পারে না। কোনো ধরণের অনুভূতিতে আঘাত কোনো সরাসরি ক্ষতির মধ্যে তো পড়েই না, এমনকি স্রেফ ক্ষতির মধ্যেও পড়ে না।

আমার মাঝে মাঝে মনে হয় যে ক্ষতি নীতিটা সবাই মেনে নেয়, কিন্তু কোনটাকে ক্ষতি বলা হবে এবং কোনটাকে হবে না সেই জায়গাতে গিয়ে সবাই আবার নিজের সুবিধামতো ব্যাখ্যা দেয়। আমাদের মধ্যে অনেকেই যারা পূর্ণ বাক-স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি তারাও এর ব্যাতিক্রম নই। ধার্মিকরা যেমন বলে ধর্মানুভূতিতে আঘাত হানাটা ধার্মিকদের জন্য ‘ক্ষতিকর’, আমাদের মধ্যে অনেকেই আবার সেভাবেই এখন বলতে শুরু করেছেন ‘উগ্র’ নাস্তিকতা অনেক নাস্তিকদের জন্য ‘ক্ষতিকর’। আমি মনে করি দুজনের যুক্তিই এখানে সমানভাবে গলদপূর্ণ। যারা এখানে ‘উগ্র’ নাস্তিকতাকে অভিদের মৃত্যুর জন্য দায়ী করছেন তারা আসলে ভুলে যাচ্ছেন যে, এই ‘উগ্র’ নাস্তিকরা কাউকে হত্যা করার কথা বলেন নি। যারা এই হত্যার পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়ন করছে তারা আজ বড়ই অসহায় বোধ করছে, তারা এতই মরিয়া হয়ে উঠেছে যে তাদের সামনে হত্যা করা ছাড়া আর কোন পথ খোলা নেই। তারা তাদের আদর্শগত অবস্থান থেকে বাক-স্বাধীনতা কিংবা অধিকাংশ মানুষের মৌলিক অধিকারগুলোকে অস্বীকার করে। তারা হত্যা এবং ভয়াবহ নিপীড়ণের নীতিকে সমর্থন করে বলেই তারা হত্যা করতে উদ্যত হয়েছে। এখানে বড্ড বড় ভুল হয়ে যায় এদেরকে বাদ দিয়ে তথাকথিত ‘উগ্র’ নাস্তিকদের দোষারোপ করলে।

তবে হ্যাঁ, এখানে একটাই ‘তবে’ আছে। এখানে বাক্-স্বাধীনতাকে ডিফেন্ড করা এবং মুক্তমনায় লেখা ছাপানোর নীতিকে আলাদা করতে পারতে হবে। মুক্তমনায় কী ছাপানো হবে কী হবেনা সেটার সিদ্ধান্ত শুধু তার মডারেশন টিমই নিতে পারে। এজন্যই এটা মডারেটেড ব্লগ। বাক্-স্বাধীনতার কারণে কোন কিছুকে সমর্থন জানিয়েও তারা তা ব্লগে বা ওয়েবসাইটে ফিচার না করতেই পারেন। এটা নিয়ে কারো কোন বক্তব্য থাকলে দয়া করে মুক্তমনা টিমের সাথে যোগাযোগ করবেন, আমি নিশ্চিত তারা সেটা মনোযোগ দিয়েই শুনবেন। যদি না শোনেন বা সেটার জন্য যথাযথ কারণ দেখাতে না পারেন তাহলে সেই সমস্যা মুক্তমনা দলের আশুই সমাধান করা উচিত। আর যদি তার আগেই আপনি সোশ্যাল মিডিয়ায় গিয়ে এ নিয়ে হৈচৈ করার সিদ্ধান্ত নেন তবে শুধুই বলবো, ‘অনেক ধন্যবাদ…’!

আমি মনে করি না ‘উগ্র নাস্তিক’দের উগ্রতর নাস্তিকতা চর্চার জন্য হুমায়ুন আজাদ-অভিজিৎ-অনন্তরা জীবন দিয়েছে। ওরা থাকলে ওরা নিজেরাই এই বক্তব্যের সাথে কোনদিন একমত হতো না। না, আমি মনে করি অভিজিৎ বা অনন্ত তাদের ‘র‍্যাশনাল থিংকিং’ এর জন্যই নৃশংসভাবে খুন হয়েছে। অথবা কেউ যদি বলেন ধর্মের কার্ডকে পুঁজি করে ওদের রাজনৈতিক খেলার ক্রসফায়ারে মারা হয়েছে সেটাও আমি বিবেচনা করতে রাজি আছি। কিন্তু ওরা ‘উগ্র’ নাস্তিকদের র‍্যাডিক্যাল কর্মকাণ্ডের দায়ভার মাথায় নিয়ে মৃত্যবরণ করেছে এটা মেনে নিতে আমি কিছুতেই রাজি হব না।ওরাও বহু কিছু লিখেছে, যেগুলোকেও র‍্যাডিকেলিজমের সংজ্ঞায় ফেলে হাউকাউ করা যায় খুব সহজেই, করছে না তো অনেকেই। আর এ কারণেই আমাদের আদর্শগত অবস্থানটা পরিষ্কার করা খুব দরকার। আপনি ইতিহাসের কোন দিকে দাঁড়াবেন সেটা নিয়ে জল ঘোলা করার অবকাশ না থাকাই উচিত। চলুন দেখি অভিজিৎ বিভিন্ন সময়ে এ প্রসঙ্গে কী বলেছে।

২০১২ সালের মার্চে মার্চ মাসে আদালত একটি রিট শুনানীর পরিপ্রেক্ষিতে ধর্মানুভূতিতে আঘাত দেবার কারণে একটি ওয়েবসাইট এবং কয়েকটি ফেসবুক পেইজ বন্ধ করে দেবার আদেশ দিলে অভি লিখেছিলো-

“ধর্মানুভূতিতে আঘাত দেবার কারণে ওয়েবসাইট ও ফেসবুক পেইজ বন্ধ” খবরটা দেখে প্রথমেই মনে হল, ‘চোখ নেই, কান নেই,কোনো বর্ণ নেই শৃঙ্খলিত নিশ্চল ঈশ্বর’ প্রকৃতির গালিচায় বসে যেন কাঁদছেন। হ্যাঁ, আধুনিক বিশ্বে ঈশ্বর পরিণত হয়েছেন এক নপুংসক সত্ত্বায়;তাই ঈশ্বরের অনুভূতি, ইমেজ এবং মানসম্মান তিনি নিজে রক্ষা করতে পারেন না, সেই সুমহান দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে তার কিছু পোষা বাহিনীর উপর। নিষ্ফল প্রার্থনা আর ব্যর্থ মোনাজাতে তেমন কাজ হচ্ছিলো না তাই অদৃশ্য ঈশ্বরের ঈশ্বরানুভূতি আর ধর্মানুভূতি আক্রান্ত হওয়ায় তার কিছু প্রিয় বান্দা আদালতের শরণাপন্ন হয়েছেন। রাষ্ট্র-যন্ত্রকে যুক্ত করেছেন।
এটা যে হবেই তা আমরা জানতাম। রাষ্ট্র-যন্ত্র সবকিছুকেই নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। মিডিয়া, টিভি, পত্রপত্রিকা, বইপত্র সবই। ইন্টারনেট আসার পর তাদের রাশ আলগা হয়ে যাচ্ছিলো ক্রমশ। যুৎ করতে পাচ্ছিলেন না তারা। এখন ধর্মানুভূতি রক্ষায় একাট্টা হয়েছেন। তারা নাকি ফেসবুকের পাঁচটি পেইজ আর একটি ওয়েবসাইট বন্ধ করে দেবেন। তারা আক্রান্ত বোধ করছেন। অভিযোগ পুরনো। সেই ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত।’
উদ্ধৃতির প্রথম প্যারায় বলা হয়েছে ধর্মানুভূতিতে আঘাত এই অভিযোগের অসাড়তার কথা এবং পরের প্যারায় বলা হয়েছে বাংলাদেশ রাষ্ট্রও মৌলবাদীদের মতোই আচরণ করছে সবকিছুর উপর নিয়ন্ত্রণ চাপানোর মাধ্যমে। অর্থাৎ তারা মৌলবাদীদের আবদার শুনছে, সেই আবদারে ধর্মনিরপেক্ষ স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানের মূল নীতি ধ্বংস হয় তো হোক, ভোট তো নিশ্চিত হল, তাতেই তারা খুশী।

এই দুইটি প্রসঙ্গ ধরে আলোচনা তারপর এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ধর্মানুভূতির অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে স্পষ্ট অবস্থান নিয়ে বলা হয়েছে, কারও যদি ইচ্ছা হয় ধর্ম/ঈশ্বর সংক্রান্ত সমালোচনা-ব্যাঙ্গ করার আমরা তার সেটা করার অধিকারকে পূর্ণ সমর্থন করি। কেনো করি সেইটার যৌক্তিক কারণও দেওয়া হয়েছে-

‘ধর্মের ‘ব্যাশিং’-এ আপত্তি? অন্য কিছুতে নয় কেন? অনেকের মনেই এরকম একটা ধারণা জন্মে গেছে যে, ধর্মকে ‘ব্যাশিং’ করা যাবে না, সমালোচনা করা যাবেনা, করলেও করতে হবে বুঝে শুনে, মাথায় ফুল চন্দন দিয়ে।
ব্যাপারটা হাস্যকর। পৃথিবীতে এমন কিছু নেই যার সমালোচনা হয় না। ছাত্রদের ইতিহাস পড়াতে গিয়ে কোন ঐতিহাসিক ভয় পান না এই ভেবে যে, চেঙ্গিস খানের সমালোচনা করা যাবে না, পাছে ‘চেঙ্গিসানুভূতি’ আহত হয়! কেউ ইতিহাস চর্চা করতে গিয়ে ভাবেন না দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসিদের অত্যাচারের কথা কিংবা জাপানী বর্বরতার কথা অথবা আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাক বাহিনীর নৃশংসতার কথা বলা যাবে না। কেউ বলেন না, এতে করে কারো ইতিহাসানুভূতিতে আঘাত লাগছে, মামলা করে দেবে! প্রথম আলোর মত পত্রিকা যখন বিজ্ঞানের নামে আগডুম বাগডুম পরিবেশন করে, আমরা বলি না আমরা আদালতের শরণাপন্ন হব, আমাদের বিজ্ঞানুভূতি বিপন্ন। অথচ ধর্মের ক্ষেত্রে সব কিছু হয়ে যায় ব্যতিক্রম। ধার্মিকদের ভঙ্গুর অনুভূতি সামান্যতেই আঘাতপ্রাপ্ত হয়। ধর্মযুদ্ধের নামে বিধর্মীদের উপর কি ধরণের অত্যাচার করা হয়েছিলো তা বললে তাদের ধর্মানুভূতি আঘাতপ্রাপ্ত হয়, পয়গম্বর-নবী-রসুল আর ধর্মের দেবদূতদের অমানবিক কার্যকলাপ তুলে ধরলে ধর্মানুভূতি আঘাতপ্রাপ্ত হয়, নারীদের অন্তরিন করে তাদের অধিকার হরণ করা হয় তা বললে আঘাতপ্রাপ্ত হয়, ধর্মগ্রন্থ গুলোতে বর্ণিত অবৈজ্ঞানিক আয়াত বা শ্লোক তুলে ধরলেও তারা আহত হন। আর ব্যঙ্গ বিদ্রূপ করা হলে তো কথাই নেই; ঈশ্বর যে ‘খুঁটি ছাড়া আকাশকে ছাদ স্বরূপ ধরে রাখেন’ তা যেন চৌচির হয়ে তাদের মাথায় তৎক্ষণাৎ ভেঙ্গে পড়ে। ধর্ম সব সময়ই কৌতুকের বড় উৎস হলেও ব্যঙ্গ এবং কৌতুকবোধের ব্যাপারটা ধার্মিকদের সাথে সবসময়ই কেন যেন রেসিপ্রোকাল। অথচ, সাহিত্য, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি চলচ্চিত্র, খেলাধুলা বা অন্যান্য যাবতীয় বিষয়কে সমালোচনা, ব্যঙ্গ বিদ্রূপ করতে তাদের বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই। কেবল ধর্মের বেলাতেই গণেশ উল্টে যায় বরাবরই।’

ঠিক একই কথা আমিও বলেছি বিবিসির ভিডিও ইন্টারভিউতেও। বলেছি, সবকিছু সমালোচনা করা জায়েজ থাকলেও ধর্মের সমালোচনা কেউ নিতে পারে না। কেনো নিতে পারবে না? একবিংশ শতাব্দীতে মানব সভ্যতার অগ্রসরতার তুঙ্গে বসে খুবি সহজ সরল প্রশ্ন এটা, খুব সহজ সরল মৌলিক দাবীও এটা একটা। এরপর সেন্সরশিপ বিষয়ে রাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে অভি বলছ,

‘রাষ্ট্র- আর আমাদের সেন্সরকারীরা ঝাঁপিয়ে পড়ছে নতুন এই ক্ষেত্র ইন্টারনেট আটকে ফেলার উপায় বের করতে। উইকিলিক্স আমেরিকার আফগানিস্তান ও ইরাক যুদ্ধের গোপনীয় বিশাল নথি, গুয়ানতানামু কারাগার এবং আমেরিকার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অসংখ্য নথি সংগ্রহ করে ইন্টারনেটে ছেড়ে দিয়ে সাংবাদিকতার এক নতুন দিগন্ত প্রতিষ্ঠা করে। আমরা দেখলাম, খুব আগ্রহ নিয়েই দেখলাম – পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র আমেরিকাও তাদের গলা টিপে ধরার প্রচেষ্টায় সফল হতে পারলো না। ২০১০-১১ সাল জুড়ে চলা মধ্যপ্রাচ্যের দেশ গুলোতে ঘনীভূত হয়ে উঠা সংগঠিত চলমান আন্দোলনের পেছনে ইন্টারনেটের এবং সামাজিক যোগাযোগ সাইটগুলোর প্রভাব আমরা সবাই দেখেছি। সিরিয়ার মতো একটি বদ্ধ দেশে থাকা মানুষেরা তাদের কথা, তাদের অবস্থা সারাবিশ্বকে জানাতে পেরেছে ইন্টারনেটের মাধ্যমে। তিউনিসিয়ায় চাকুরিবিহীন বেকার যুবকদের আগুনে আত্মাহুতি দেবার ঘটনাকে কেন্দ্র করে তিউনিসিয়ার সরকারের প্রতি যে বিক্ষোভ দানা বেঁধে উঠেছিলো তাকে ঠেকাতে ইন্টারনেটের সংযোগ বন্ধ করে দিয়েছিলো সরকার। লাভ হয়নি, বরং তিউনিসিয়ার সফল বিপ্লবকে চিহ্নিত করা হয়েছে ‘The Story of the First Successful Internet Revolution’ হিসেবে। মিশরের বিপ্লবীরাও যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেছে ইন্টারনেট। মিশরের সরকার গদি বাঁচাতে ফেসবুক ইউটিউব টুইটার বন্ধ করে দিয়েছিলো, লাভ হয়নি সেখানেও। বাংলাদেশে এই আওয়ামীলীগ সরকারের আমলেও কদিন আগে যখন ধর্মানুভূতি এবং রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীর ইমেজানুভূতিতে আঘাত করার জন্য ফেসবুক বন্ধ করার পায়তারা নেয়া হয়েছিলো তখন জনমানসে কি ভয়ঙ্কর প্রতিক্রিয়া হয়েছিলো, কিভাবে সরকার আবার নিজেদের হাস্যাস্পদ করে অবশেষে ফেসবুককে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলো, রাষ্ট্রের কর্ণধারেরা নিশ্চয় তা ভুলে যায় নি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, ভুল থেকে শিক্ষা নিতে তাদের খুব কমই দেখা গেছে।
রাষ্ট্রের কর্ণধারেরা এখন তাই আবার নড়ে চড়ে বসেছে, আরেকটি মহাভুল আবারো করার জন্যই বোধ হয়। আবারো ইন্টারনেটের মুখ চেপে ধরতে তারা বদ্ধপরিকর। দিকে দিকে ব্লগ, ফেসবুক, টুইটারের নামে মামলা, কনটেন্ট মোছার আবেদন, ব্লক আরও কতো কি। যখন এগুলোতে ফায়দা হয় না, তখন হয় শারীরিক আক্রমণ। কিন্তু তারা ভুলে যান, হুমায়ুন আজাদকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়েও মুক্তবুদ্ধির অগ্রযাত্রা স্তিমিত করা যায়নি; বরং আমরা বেড়েছি, চারা গাছ হিসেবে জন্ম নিয়ে মহীরুহ আকারে ছড়িয়ে পড়েছি এখানে ওখানে সর্বত্র। কয়জনকে হেনস্থা করবে, কয়টা সাইট বন্ধ করবে? আজকে যে কোন ব্লগে গেলেই, কিংবা ফেসবুক, টুইটারের যে কোন জায়গাতেই মুক্তবুদ্ধির স্বপক্ষে হাজারো আলোচনা চোখে পড়ে। কেবল পাঁচ ছয়টি সাইট বন্ধ করে দিলেই সব শেষ হয়ে যাবে? আর, ধর্মানুভূতির জিগির তুলে ফেসবুকের পাঁচটি পেজ আর একটি সাইট বন্ধের বিরুদ্ধেও লেখা শুরু হয়েছে বিভিন্ন ব্লগে, অজস্র প্রতিবাদ হয়েছে ফেসবুকেও (দেখুন এখানে কিংবা এখানে)। কাজেই মুখ বন্ধ করার জন্য স্কচ-টেপ নিয়ে ঘুরে বেড়ালেই সবার মুখ বন্ধ হবে তা ভাবা বাতুলদের ‘বাতুলতা’। মুক্তমনারা আজ আর একটি সাইটে নয়, মুক্তমনা একটি সফল আন্দোলনের নাম যা ছড়িয়ে আছে অসংখ্য সাইটে,ফেসবুক পেইজে, মানুষের মনে, চিন্তা-চেতনায়। প্রতিক্রিয়াশীলদের প্রতিক্রিয়ায় এ আন্দোলন রাতারাতি বন্ধ হয়ে যাবে -সেটা ভাবার কোনো কারণ নেই।

তবে আবহাওয়া খারাপ বলার জন্য রেডিও জকিদের উপর মামলা-হামলা কতোদিন চলবে সেটাই এখন দেখার বিষয়।”

আসলেইতো মুক্তমনা নামটা আজ তো আর একটা সাইটের জন্য ব্যবহার করা হয়না। মুক্তচিন্তকদের ভালোবেসেও বাংলায় মুক্তমনা ডাকা হয়, আবার গালি দিতে গিয়েও তাদেরকে মুক্তমনা বলে দুটো কান মলা দিয়ে দেওয়া হয়।

চিন্তা করে দেখলাম মুসলিম অধ্যুষিত বাংলাদেশে আসলে সবারই ইসলাম ধর্ম ছাড়া অন্য ধর্মের সমালোচনা করার অধিকার আছে। মসজিদে, খুৎবায়,ওয়াজে প্রায়শই তো অবিশ্বাসীদের হুমকি ধামকি দেওয়া হচ্ছে। কুরআনেও তো কম হুমকি ধামকি নেই। কোন বিধর্মী বা আমার মত অবিশ্বাসীকে কীভাবে শাস্তি দেওয়া হবে স্বর্গে এবং মর্ত্তে তার গ্রাফিক ব্যাখ্যাও দেওয়া আছে। আমাদের দেশে ধর্মানুভূতির আঘাতের কান্নাকাটির ব্যাপারটা কি শুধু তাহলে ইসলাম ধর্মের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য? যেমন ইউরোপে প্রযোজ্য ছিল খৃষ্টান ধর্মের ক্ষেত্রে কোপার্নিকাস, গ্যালিলিও বা ব্রুনোর সময়ে বা তারো আগে?

কয়েকদিন আগে দেশে প্রচারিত বিবিসির ট্রেন্ডিং এর রেডিও অনুষ্ঠানটা শুনে হতভম্ব হয়ে গেলাম। ওদের ইউরোপে প্রকাশিত অনুষ্ঠানগুলোর সাথে কী বিশাল পার্থক্য! আমাকে ভল্টেয়ার লেকচারের সময় লন্ডনে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল মিডিয়া সম্পর্কে কী মনে করি। উত্তরে বলেছিলাম ওটাও তো একটা ব্যাবসাই, সেটাই মনে পড়ে গেল। যস্মিন দেশে যদাচারের ব্যবসা। যেখানে যেটা করলে লাভ হয় সেটারই ব্যবসা মিডিয়া। অনুষ্ঠানটা শুনতে শুনতে মনে হলো আমাকে, ডঃ অজয় রায় (অভিজিতের বাবা), অভিজিৎ, রাজীব, বাবু, অনন্তদের সবাইকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে যেন আমাদের আখেরাতি বিচার করে ফেলা হল। মুক্তমনাদের পক্ষের কেউ ছিল না সেখানে আমাদের পক্ষ হয়ে কিছু বলার জন্য! একজন ‘সেক্যুলার’ ব্লগার ছিলেন অবশ্য, তিনিও সুযোগে মসজিদ কমিটির সাথে তার সংশ্লিষ্টতার উল্লেখ করতে ভুলেন নি। খুব গুরুত্ব দেওয়া হলো দেখলাম জামায়াত-শিবির এক পলাতক আসামীর কথাকে, আসল কথাবার্তা অনেক দূরে সরিয়ে শেষ বিচারের রায়ে বলা হইলো আমগো মৃত্যুর জন্য, কুপানি খাওয়ার জন্য আমরাই নাকি দায়ী! এমন ভাষায় ধর্মকে আঘাত করলে তাদের ধর্মানুভূতি যে ভেঙ্গে খানখান হয়ে যায় সেইটা আমরা বুঝি না কেন! দেশের প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে বাজে কথা বললে যদি শাস্তি হতে পারে তার চেয়ে হাজার গুণে বড় সৃষ্টিকর্তাকে আঘাত করলে শাস্তি (পড়ুন, দোয়া দরুদের শক্তিতে বলীয়ান পবিত্র চাপাতির আঘাতে মৃত্যু) পাবে না কেন ব্লগাররা। শাহবাগের ওইসব ঘৃণ্য ব্লগাররা কাদের মোল্লার ফাঁসী চেয়েই তো মৌলবাদী মিলিট্যান্টদের আস্কারা দিয়েছে। ওদের নিরেট ফতোয়া-ভরা বুদ্ধি গিজগিজ করা মাথায় নাকি আমরাই এই কোপাকুপির ধারণা পুরে দিয়েছি। কত রঙ্গ দেখবো বল… দেখার তো শেষ নেই… এটা জেনেও কেমন যেনো বারবার হোঁচট খাইতেই থাকি।

সবশেষে একটাই অনুরোধ মুক্তমনাদের প্রতি, তাদের বন্ধু এবং সহানুভূতিশীলদের প্রতি। আমাদের মোটেও ভুলে যাওয়া চলবেনা যে, ফেসবুকে তথাকথিত ‘কুৎসিত ভাষায়’ স্ট্যাটাস দেওয়া ‘উগ্র নাস্তিকদের’ ছোট্ট দলটার বিরুদ্ধে আজ আমাদের যুদ্ধ নয়। ওদের কন্সট্রাকটিভ সমালোচনা করুন তাতে কেউ বাধা দিচ্ছে না। হুমায়ুন আজাদ, অনন্ত, রাজীব, বাবু, অভিজিৎদের মৃত্যুর জন্য কোনভাবেই তারা দায়ী নয়। অভিজিৎদের ধারণ করা দর্শনকে এত সংকীর্ণভাবে ব্যাখ্যা করবেন না দয়া করে। আজকের যুদ্ধ হচ্ছে বিশ্বব্যাপী চাগিয়ে ওঠা ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে, তাদের যারা তৈরি করেছে এবং টিকিয়ে রাখছে নিজের স্বার্থে সেইসব জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক শক্তির বিরুদ্ধে। আমি মনে করি সাম্রাজ্যবাদ এবং বিশ্বব্যাপী দারিদ্র-বৈষম্য এবং লুটপাটের বিরুদ্ধে দৃঢ়ভাবে দাড়িয়েও অন্ধ-ঘৃন্য ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা সম্ভব। মনে রাখবেন, পঁচে যাওয়া ফরহাদ মজহাররাই আজ একমাত্র সমধান নয়। সম্প্রতি অক্সফোর্ড থেকে এ বিষয়ে গবেষণা করার পর প্রেসেডেন্সি কলেজের শিক্ষক মঈদুল ইসলাম একটা বই লিখেছেন ‘লিমিট অফ ইসলাম’ নামে। যদূর পড়েছি তাতে মনে হচ্ছে উনি অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে প্রশ্ন করেছেন নিও-লিবারিলিজম এবং ইসলামিজম ছাড়া আর কোন পথ কি খোলা নেই আমাদের মানব সভ্যতার সামনে এই মুহূর্তে? বইটা এখনো পড়ে শেষ করিনি। তবে আমি মনে করি এধরণের প্রশ্নগুলোকেই আজ আমাদের সামনে নিয়ে আসা উচিত। এইসব অযথা বিতর্কে সময় নষ্ট না করে অর্সথনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক লাইন নির্ধারণের মাধ্যমে শত্রু-মিত্রের সংজ্ঞা ঠিক করে একসাথে সামনে আগানোর শপথ নেওয়াটাই আমাদের একমাত্র কাজ হওয়া উচিত এই মুহূর্তে।