ব্রিটিশ হিউম্যানিস্ট এসোসিয়েশন আয়োজিত এ বছরের ভলতেয়ার লেকচার নিয়ে নিক কোহেনের গার্ডিয়ানের “Islamism prevails even as we suppress free speech” আর্টিকেলটির বাংলা অনুবাদ।

1

কেউ কি কখনও ভাবতে পেরেছিলো গত সপ্তাহে লন্ডন দেখা পাবে বাংলাদেশি লেখক, রাফিদা আহমেদ বন্যার? বন্যার বেঁচে থাকাটাই একটা অলৌকিক ব্যাপার- যদিও “অলৌকিক” শব্দের ব্যবহারে কড়া আপত্তি জানাবেন তিনি। ব্রিটিশ হিউম্যানিস্ট এসোসিয়েশন আয়োজিত এ বছরের ভলতেয়ার লেকচারে বন্যা আহমেদের বক্তব্য শোনার সময় আমার মনে হচ্ছিলো তার মতো একজন মানুষের বুদ্ধিদীপ্ত আলোকিত জীবনবোধকে আমরা কেবল ছড়িয়ে দিতে পারি, প্রতিটি কথার পাশে দাঁড়াতে পারি। কখনও ভাবতেও পারি না এমন মানুষের ক্ষতি চাইবে কেউ, তাকে মেরে ফেলতে চাবে সেই ভাবনা তো অনেক দূরের কথা।

কিন্তু অনেকেই চায়। এ বছর ফেব্রুয়ারিতে ইসলামি মৌলবাদীরা তার স্বামী অভিজিৎ রায়কে ঢাকায় বইমেলা থেকে ফেরার পথে মাংসকাটার চাপাতি দিয়ে নির্মমভাবে কুপিয়ে হত্যা করেছে। বন্যা আহমেদও আক্রমণের শিকার হন এবং তিনি ফিরে এসেছেন মৃত্যুর দ্বার প্রান্ত থেকে। আক্রমণের কারণে বন্যার শরীর জুড়ে ক্ষত, হারিয়েছেন একটি বৃদ্ধাঙ্গুল। বন্যার কাছ থেকে তার প্রয়াত স্বামীর কথা শুনে আমার খুব ইচ্ছা হচ্ছিল অভিজিতের সাথে পরিচিত হতে। অভিজিৎ ছিলেন একজন আদর্শ বুদ্ধিজীবী- জাগতিক ব্যাপারে আনাড়ি, কিন্তু সাহিত্য, বিজ্ঞান আর মুক্ত বিতর্ক প্রেমিক।

একত্রে বন্যা আহমেদ এবং অভিজিৎ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বাংলা ভাষার বৃহত্তম ধর্মনিরপেক্ষ ব্লগ যেখানে স্বাধীনচেতা বাংলাদেশি তরুণরা লেখেন মানবতাবাদ নিয়ে, বিবর্তন নিয়ে। নির্ভীক চিত্তে তারা দুইজনই বিরোধিতা করতেন যেকোনো অসহিষ্ণুতা, প্রতিক্রিয়াশীলতা। ২০১৪ সালে প্রকাশিত অভিজিতের লেখা “বিশ্বাসের ভাইরাস” বইটিও ছিলো সেই নির্ভীক চিত্তের সাহসী উদাহরণ। এই নির্ভীক চিত্তের প্রতিপক্ষকে দেখে ভয় পেয়ে, তার শত্রুরা তাকে হত্যা করে, তার আদর্শকে হত্যার জন্যে।

বন্যা তার বক্তব্যে বলেছেন, কীভাবে আপসের রাজনীতি গ্রাস করেছে বাংলাদেশকে। আপনি যদি ভাবেন এই আপসকামী রাজনীতি শুধু বাংলাদেশের জন্য প্রযোজ্য, যুক্তরাজ্যের জন্য নয় তাহলে আপনি ভুল করবেন। যে কক্ষে বক্তব্য দিয়েছিলেন বন্যা সেই কক্ষে রাখতে হয়েছে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা, দরজায় বসাতে হয়েছে নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনী। যারা বন্যার কথা শুনতে এসেছেন তাদের প্রত্যেকের ব্যাগ তল্লাশি করা হয়েছে অস্ত্র কিংবা বোমার অনুপস্থিতি নিশ্চিত করতে। একজন বিধবা, যার চাপাতির ক্ষতগুলো এখনো তাজা, নিজের চিন্তা শক্তি ছাড়া যার নেই কোনো অস্ত্র, সেই মানুষটি ঢাকায় যেমন আক্রমণের লক্ষ্য, লন্ডনেও তাই।

এখানেই তুলনার শেষ নয়। অভিবাসনের ফলে ব্রিটিশ রাজনীতিতেও বাংলাদেশি রাজনীতির প্রভাব রয়েছে। আপনি কখনই বুঝতে পারবেন না কেনো লন্ডনের পূর্ব পাশ জর্জ গ্যালোয়ারের মতো কদর্য রাজনীতিবিদকে প্রত্যাবাসিত করে, বুঝতে পারবেন না কেনো তারা বারবার নতজানু হয় মেয়র লুৎফর রহমানের মতো একটা লোকের সামনে, যদি না আপনি জানেন যে টাওয়ার হ্যামলেট হচ্ছে ব্রিটেনে জামায়াত ইসলামীর শক্ত ঘাঁটি। আপনি যখন জানবেন যে এখানে বাংলাদেশি এই ধর্মীয় ডানপন্থী দলটি তাকেই ভোট দিয়ে ক্ষমতায় আনবে যে এদের অন্ধবিশ্বাসের সামনে নতজানু হবে, তাহলে পূর্ব অঞ্চলের এই বিদঘুটে রাজনৈতিক পরিস্থিতি আপনার কাছে আর অতটা উদ্ভট মনে হবে না।

আর সবচেয়ে বড় কথা, ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদ যে ধরনের ভীতির সঞ্চার করে, মানুষকে যে মিথ্যা প্রবোধ দেয়, এবং যেসব ছাড় দিতে বাধ্য করে তা উপমহাদেশেও যেমন এখানেও ঠিক তেমনই।

বাংলাদেশ নিয়ে আজ নিরাশায় ভুগছেন বন্যা। ইসলামপন্থীরা শুধু তার আপনজনকে হত্যা করেই ক্ষান্ত দেয় নি, এরপরই হত্যা করেছে আরও দুই জন নাস্তিক ব্লগারকে। বাংলাদেশ রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব থাকা দলটি পরিচয়ে ধর্মনিরপেক্ষ এবং ইসলামপন্থীরা সেই ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর থেকেই স্বাধীন এই রাষ্ট্রটির ধর্মনিরপেক্ষতার মূলনীতির বিরোধিতা করে আসছে। যেই বিরোধিতার কারণেই জামায়াত ইসলামি সেসময় সহায়তা করেছিলো পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মর্মান্তিক আগ্রাসনকে, অংশ নিয়েছিলো গণহত্যা, লুটতরাজে। এইটুকু জেনে আপনি হয়তো মনে করবেন অভিজিতের শত্রুর বিরুদ্ধে সর্ব শক্তি দিয়ে লড়াই করবে বর্তমান ধর্মনিরপেক্ষ সরকারী দল।

কিন্তু তা হয় নি। ১৯৭১ এর যুদ্ধের কর্মকাণ্ড বিবেচনা করে যখন একজন খ্যাতনামা জামায়াত নেতাকে বিচারের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হলো, তখন এর প্রতিক্রিয়ায় ইসলামপন্থীরা শ খানেক সেক্যুলারিস্টকে চিহ্নিত করে দাবি তুলল এরা তাদের “কোমল” ধর্মানুভূতিতে আঘাত করেছে তাদের ধর্মকে “অপমান” করে তাই এদেরকেও ব্লাসফেমির কারণে বিচার করে মৃত্যুদণ্ড দিতে হবে। জবাবে বাংলাদেশ রাষ্ট্র তাদের স্মরণ করিয়ে দিতে ব্যর্থ হয়েছে যে, একজন বাংলাদেশির সাংবিধানিকভাবেই চিন্তার স্বাধীনতা রয়েছে। উলটো তারা বলেছে, মান্ধাতা আমলের ব্রিটিশ রাজত্বের অনুকরণে তারা এই “ধর্ম বিদ্বেষী”দের বিচারের আওতায় আনবে যথাযথ কর্তৃপক্ষ এবং আইনের মাধ্যমে।

বাংলাদেশি মুক্তচিন্তার মানুষেরা আজ তাই যেমন ইসলামপন্থীদের হত্যার তালিকায় ঠিক একইভাবে পুলিশেরও গ্রেফতার তালিকায়। চাপাতি নিয়ে হত্যাকারীরা তাদের খুঁজে না পেলেও ওয়ারেন্ট হাতে পুলিশ ঠিকই পাবে। বাংলাদেশের জন্য এ এক লজ্জা, যে রাষ্ট্রটি বন্যা এবং অভিজিতের সাথী এবং বন্ধুদেরও “ধর্মানুভূতিতে আঘাত” এর অপরাধ এবং সামাজিক সম্প্রীতি নষ্টের অভিযোগ এনে জেলের ভয় দেখাচ্ছে।

লেনিন বলেছিলেন, “পুঁজিবাদীদের আমরা যেই দড়ি দিয়ে ঝোলাবো সেই দড়িটাও ওরা আমাদের বিক্রি করবে”। বাংলাদেশের ইসলামপন্থীরাও নিশ্চয়ই ঠিক এমনটিই ভাবছে “মধ্যপন্থী” বাংলাদেশ সরকারকে নিয়ে যেই সরকারকে তারা ধ্বংস করতে চায়। জঙ্গিবাদের সুস্পষ্ট বিরোধিতা করে মানবাধিকার রক্ষায় কাজ না করে, বাংলাদেশ স্বাধীনচেতা ধর্ম সমালোচকদেরই দোষী সাব্যস্ত করে জঙ্গিবাদকে হালাল করছে। শেখ হাসিনার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় রয়টার্সকে দেওয়া এক ন্যাক্কারজনক সাক্ষাৎকারে বলেছেন তার মা রায় এর পরিবারকে গোপনে সান্ত্বনা জানানোই বুদ্ধিমানের কাজ মনে করেছেন। এই অবিবেচক মানুষটি আরও বলেছেন, যদিও “আমরা ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাস করি” বিরোধী দল যেহেতু আমাদের বিরুদ্ধে বারংবার ধর্মীয় চাল চালে, আমরা এই ব্যাপারে সরাসরি শক্ত অবস্থান নিতে পারছি না। বাস্তবতার চেয়ে এখানে ভাবমূর্তি রক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। (ঘটনাক্রমে তারা দুইজনেই আমাদের নব নির্বাচিত লেবার পার্টির সংসদ সদস্য টিউলিপের আত্মীয়)।

অভিজিৎ রায় তাঁর জীবন দিয়েছেন কারণ তিনি বাস্তবতাকে বদলাতে চেয়েছিলেন, কোনো ভাবমূর্তি নয়। এ কাজের ঝুঁকি তিনি জানতেন, এটাও জানতেন কিছু যুদ্ধ এড়িয়ে যাবার নয়। “যারা মনে করে বিনা রক্তে বিজয় অর্জিত হবে তারা বোকার স্বর্গে বাস করছে”, তিনি লিখেছিলেন তাঁর মৃত্যুর আগে, “যেই মুহূর্তে আমরা মৌলবাদ এবং ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে কলম তুলে নিয়েছি সেই মুহূর্ত থেকে আমরা মেনে নিয়েছি আমাদের জীবন ঝুঁকি।”

আসুন বাংলাদেশি এই বুদ্ধিজীবীদের সাথে পশ্চিমা বুদ্ধিজীবীদের সাহসিকতার তুলনা করি। পশ্চিমা বুদ্ধিজীবীরা কীভাবে আমাদের যুগের ফ্যাসিজম বিরুদ্ধে যুক্তি দেখাতে ব্যর্থ হয়েছেন তা নিয়ে কয়েকটা বই লেখা যাবে — অবশ্য আমি নিজেই এ বিষয়ে একাধিক বই লিখেছি— সবচেয়ে বড় কারণটি হলো মূল সমস্যার নাম উল্লেখ করার ভয়। পশ্চিমা বুদ্ধিজীবীরা ভীত এমন অবস্থান নিলে লোকে তাদের বর্ণবাদী বলবে, তারা ভীত প্রচলিত মতের বাইরে কিছু বলতে, সবচেয়ে বড় কথা তারা ভয়ে থাকে সহিংস আক্রমনের। অবশ্য তারা স্বীকার করতে চান না যে তারা ভীতু। নিজদের দূর্বলতার মাছকে শাক দিয়ে ঢাকার চেষ্টাতেই জীবন পার করে দেন তারা। তারা ধর্মীয় জঙ্গিবাদকে দারিদ্র্য এবং পশ্চিমা বৈদেশিক নীতির যৌক্তিক প্রতিক্রিয়া হিসাবে দেখান। তারা বলতে চান, নৈতিকতার দৃষ্টিতে উগ্র ধর্মীয় জঙ্গিবাদ ও উগ্র নাস্তিকতা সমতুল্য।

কিছু ক্ষেত্রে তারা আরও একধাপ এগিয়ে বলা শুরু করেন যেমন বলেছেন লন্ডন স্কুল অফ ইকোনোমিকসের পরিচালক অধ্যাপক ক্রেইগ কালহাউন। অধ্যাপক সাহেবের মতে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা যে মানুষ হত্যা আর ধর্ষণ করতে সিরিয়া চলে যাচ্ছে সেটা সমস্যা না, আসল সমস্যা হচ্ছে ধর্ম নিরপেক্ষ, বাক-স্বাধীনতায় বিশ্বাসীরা যারা “ধার্মিক ছাত্রদের বিশ্বাসকে চ্যালেঞ্জ করছে” এবং “ক্যাম্পাসের সম্প্রীতি” নষ্ট করছে তারা। লন্ডন স্কুল অফ ইকোনোমিকস থেকে জঙ্গিবাদ নির্মূলে ভালোই সমস্যায় পড়বেন ডেভিড ক্যামেরুন।

এত সব মিল সত্ত্বেও নৈতিক অবস্থানে ব্রিটেন ও বাংলাদেশের কোনো মিল নেই। বাংলাদেশে আছে বন্যা, অভিজিতের মতো ধীশক্তির মুক্তচিন্তক যেখানে আমাদের আছে কিছু “উদারপন্থী” যাদের দিকে তাকিয়ে কার্ল মার্ক্স হয়তো বলতেন- “ধর্ম হচ্ছে বুদ্ধিজীবীদের আফিম”।