সেই ছেলেবেলা থেকে প্রবীর ঘোষ নামের “যুক্তিবাদী” মানুষটি ছিলেন মনোজগতে এক নায়ক হিসেবেই।
প্রচলিত কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তাঁর যুদ্ধ, ধর্ম-ব্যবসায়ীদের মুখোশ খুলে দেওয়ার দৃঢ়তা সহ বিভিন্ন অসাধারণ সব লড়াই আমাদের উদ্দীপ্ত করেছে; তিনি নিজেই ছাপিয়ে গেছেন নিজেকেই।
এইযে নিজেকে ছাপিয়ে যাওয়ার সাফল্য, সেটা আবার সকলকে সয়না, প্রবীর ঘোষও পারেননি, তিনিও নিজেকে আজ আবদ্ধ করেছেন আমিত্বের ঘেরাটোপে। আর তাই যুক্তি তাঁর “বোধ”কে পরিচালিত করছে না, বরং তাঁর মধ্যে গড়ে ওঠা “বাদ” বা মতাদর্শ আজ পরিচালনা করছে তাঁর যুক্তিকে। মতাদর্শ থাকা অন্যায় কিছু নয়, সেটি একটি দার্শনিক প্রবণতা ও ইতিবাচক, কিন্তু যুক্তিকে সেই প্রবনতার মাঝে আবদ্ধ করে তুললে যুক্তি হয়ে পড়ে খণ্ডিত, হয়ে ওঠে নেতিবাচক। এই যে আমিত্বের নেতিবাচকতা, তা বামন নার্সিসাসদের পরিণত করে এক একটি কুয়োর ব্যাঙে; বৃত্তাবদ্ধ যুক্তি পথ হারিয়ে আচ্ছন্ন করে হৃদয় আর মস্তিস্ককে, প্রগতিশীল মানুষটিও হয়ে ওঠেন প্রতিক্রিয়াশীল, বনে যান ছাতাপড়া বুদ্ধিজীবীতে।
প্রবীর ঘোষ সম্প্রতি যৌন-স্বাধীনতাকে বলেছেন সাংস্কৃতিক সন্ত্রাস এবং তাকে সমতুল্য করেছেন যৌন-অজাচারের সাথে, যার মধ্যে আছে সমকামিতা প্রসঙ্গটিও; এমনকি তিনি অপ্রাসঙ্গিক ভাবেই টেনে এনেছেন সদ্য প্রয়াত অভিজিৎ রায়কেও; তাঁকে অভিযুক্ত করেছেন সমকামিতা প্রমোট করবার অভিযোগে। বিষয়টি বেশ কৌতূহলউদ্দীপক, কারন তিনি দোহাই দিয়েছেন বিজ্ঞানের, প্রগতির, স্বাধীনতার, যুক্তির এবং সাম্যের; অথচ স্পটভাবেই তিনি নিমজ্জিত দারুন স্ববিরোধীতায়। আমিত্বের ঘেরাটোপে বসবাসরত প্রবীর ঘোষ বিরুদ্ধাচারন করছেন বিজ্ঞানের, প্রগতির, স্বাধীনতার, যুক্তির এবং সাম্যের। আধুনিক জ্ঞানচর্চার সাথে সম্পর্কহীনতায় প্রবীর ঘোষও পরিণত হয়েছেন অশিক্ষিত এক কু-যুক্তিবাদীতে। কু-যুক্তি আজ তাঁকে এতটাই আচ্ছন্ন করেছে যে মানবিক অধিকারের বিষয়টিও তাঁর কাছে, প্রচলিত প্রথার সামনে হয়ে উঠেছে দ্রবীভূত। অজ্ঞানতার আঁধারে বসবাসরত প্রবীর ঘোষেরা ভুলে যান এটি প্রমোট করবার বিষয় নয়, এটি স্বেচ্ছায় বেছে নেওয়ার বিষয় নয়, এটি প্রকৃতি বিরুদ্ধ আচরণ নয়, এটি আমাদের পিছিয়ে পড়া ধর্মাশ্রয়ী সমাজের একটি ‘ট্যাবু টপিক’, যাকে স্বাভাবিক ভাবে নেয়া আমাদের শিখতে হবে। এই মানসিক চিন্তাধারার উত্তরণে প্রবীণ প্রবীর ঘোষ আজ নির্লজ্জভাবে ব্যর্থ।
এই যে বৃত্তাবদ্ধ প্রবীর ঘোষ, যিনি এককালে লড়তেন প্রচলিত কুসংস্কারের বিরুদ্ধে, আজ তিনিই চাইছেন মানবীয় আচরণকে, মানুষের স্বাধীনতাকে নিয়ন্ত্রন করতে, যুক্তির ছদ্মাবরনেই; আর সে প্রয়াসে ধর্মবাদীদের মতই তিনিও ব্যবহার করছেন প্রচলিত ইমোশনাল ট্রাম্প-কার্ড।
তাঁর নিজের ভাষাতেই…
‘ বিনীত ভাবে জানতে চাই- কোনো সমকামী ‘দম্পতি’-র মধ্যে যৌন সংসর্গ কিভাবে সম্ভব, যা আপনাদের মতে প্রকৃতির নিয়ম মেনে বা না মেনে? পুরুষের সঙ্গে পুরুষের? নারীর সাথে নারীর? অথবা পুরুষ বা নারীর সাথে কোন পশুর???’
তিনি আরও বলেছেন …
যারা চীৎকার করে ‘পারস্পরিক সম্মতি’-তে গড়ে ওঠা সমস্ত যৌনসম্পর্ক-কেই স্বাধীনতার দোহাই দিয়ে স্বীকৃতি দিতে চাইছেন, তাদের কাছে প্রশ্ন-আপনারা নিশ্চয়ই পিতা-কন্যা, মাতা-পুত্র, ভাই-বোন ইত্যাদির মধ্যে পারস্পরিক সম্মতিতে গড়ে ওঠা যৌন-সম্পর্ককেও উদাত্ত কণ্ঠে স্বাগত জানাবেন। স্বীকৃতি দেবেন যৌন-ব্যবসাকেও। যদি আপনাদের পরিবারের কেউ বা নিকটজন এই ব্যাবসায় আসতে চায়, নিশ্চয়ই উচ্ছ্বসিত বোধ করবেন। যদি বলেন ‘না’, তবে আপনাদের ‘যুক্তি’-র জালে নিজেরাই জড়িয়ে যাবেন, কারণ, এখানেও আছে যৌন-সঙ্গী বেছে নেবার ( আপনাদেরই ভাষায় ) অবাধ স্বাধীনতা।
কু-যুক্তির জাল ছড়িয়ে ঘোলা পানিতে প্রকৃতপক্ষে কি শিকার করতে চাইছেন প্রাক্তন এই যুক্তিবাদী?
মানুষের যৌন অধিকার?
কি হবে তাঁর পরবর্তী কু-যুক্তি? যুক্তির নামে ব্লাসফেমিকে স্বীকৃতি দেওয়া? নারীর অধিকার হরন? আদিবাসীর অধিকার হরন?
তিনি যে শোভন/ শালীন/ শ্লীলতা/ অশ্লীলতাকেও আজ সংজ্ঞাবদ্ধ করার জন্য বড়ই উদগ্রীব।