(অনুবাদকের নোটঃ অস্ট্রেলিয়ায় তখন জন হাওয়ার্ডের সময়। ২০০১ সাল। ১৯শে অক্টোবর তারিখে ইন্দোনেশিয়া থেকে ৪২১ জন যাত্রী নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করা একটি নামহীন নৌকা সাগরে ডুবে যায়। তাতে মারা যায় ৩৫৩ জন যাত্রী, যার মধ্যে ছিল ৬৫ জন পুরুষ, ১৪২ জন নারী ও ১৪৬ জন শিশু। ২০০১ সালে অস্ট্রেলিয়ান ফেডারেল নির্বাচনের ঠিক আগে এই ঘটনা ঘটে, যখন দুই রাজনৈতিক দলের প্রধানেরা অবৈধ বোট পিপলের ব্যাপারে কে কার চেয়ে কতখানি বেশি কঠোর হতে পারেন, সেই প্রতিযোগীতায় লিপ্ত ছিলেন। নৌকাটি ডুবেছিল সাগরের এমন এক জায়গায়, যেটি না ইন্দোনেশিয়ার, না অস্ট্রেলিয়ার, অর্থাৎ ইন্টারন্যাশনাল ওয়াটার। অস্ট্রেলিয়ান নেভীর কাগজ-পত্রে এই অবৈধ নৌকাটির কোড নাম SIEV-X (Suspected Illegal Entry Vehicle – Unnamed)। SIEV-X থেকে বেঁচে যাওয়া এক ইরাকী নারী অমল বাসরীকে নিয়ে এই গল্পটি লিখেছেন আরেকজন উদ্বাস্তুপুত্র, আর্নল্ড জেবল। গল্পটি তার ‘দ্যা ভায়োলিন লেসনস’ গল্পগ্রন্থ থেকে নেওয়া। আর্নল্ড জেবল পোলিশ ইহুদী বাবা-মা’র সন্তান, বাবা মায়ের সাথে উদ্বাস্তু জীবন কাটিয়েছেন অনেকদিন। তিনি একাধারে একজন লেখক, শিক্ষক এবং মানবাধিকার কর্মী। থিতু হয়েছেন মেলবোর্নে। উদ্বাস্তুদের জীবনসংগ্রাম তার লেখার বিষয়বস্তু ও প্রেরণা। তিনি একজন গল্প কথক – ছোট গল্প এবং আত্নজৈবনিক মেমোয়ার বা স্মৃতিকথা নিয়েই তার কাজ কারবার। ‘জুয়েলস এন্ড এশেজ’, ‘ক্যাফে শেহেরজাদ’, ‘সী অফ ম্যানি রিটার্নস’ সহ তার লেখা বেশ কটি বই অস্ট্রেলিয়ায় প্রশংসিত ও পুরস্কৃত হয়েছে)

AmalBasry

তার জন্মের পরে তার মা ছেলের জন্ম দিতে না পেরে আক্ষেপ করেছিলেন। তার বাবা ঘোষণা করেছিলেন, আমি মন খারাপ করি নি। মেয়ে হওয়াতেই বরং আমি খুশী। বাবা তার নাম রেখেছিলেন অমল, যার অর্থ আশা। বাবা তাকে তাদের পরিবারের পুরাতন কালো-সবুজাভ রঙের মরিস গাড়িতে করে নানা জায়গায় ঘুরতে বেরুতেন। প্রতি শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটির দিনে বাবা গাড়ি চালিয়ে যেতেন টাইগ্রীস নদীর পাড়ে, নদীর তীর ঘেঁষে হাঁটতে। সেখানে হাঁটতে হাঁটতে তিনি তার স্মৃতির ভাণ্ডার থেকে গুনগুন করে গাইতেন আরবী গানের একচ্ছত্র সম্রাজ্ঞী উম্মে কুলসুমের কোন গানের কলি।

একদন সকালে বাবা মেয়ে হাঁটার সময় টাইগ্রীস নদীর পাড়ে দৃশ্যমান হল একটা জটলা – কালো কাপড় পরা কান্নারত কিছু মানুষ। বাবা, এদের কি হয়েছে, অমল জিজ্ঞেস করে। ‘ওদের একজনের ছেলে নদীতে ডুবে গেছে, তাই ওরা নদীর পাড়ে অপেক্ষা করছে কখন ছেলেটির লাশ ভেসে উঠবে’, বাবা উত্তর দেয়। ‘লাশ পানিতে ভেসে থাকতে পারে, কারণ মৃত্যুর পরে তা হালকা হয়ে যায়।’

সেই ঘটনার অনেক দিন পরে অমল আমাকে বলে, ‘অথৈ সাগরের মাঝখানে ভাসতে ভাসতে আমি অনেকবারই মৃত্যুর কথা ভেবেছি, মরতে চেয়েছি। হয়তো আমি মৃত্যুর দূতের জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু আমার মনে পড়েছিল শৈশবের সেই সকালে টাইগ্রীসের পাড়ে আমার বাবার বলা কথাটা, লাশ ভেসে থাকে। আমি একটা মহিলার লাশ ধরে ভেসে থাকি। আমি উম্মে কুলসুমের গান শুনতে পাই। এবং আমার বাবার গুনগুন, যেমনটা শুনতাম টাইগ্রীসের পাড়ে বাবার হাত ধরে হাঁটার সময়। এই গানই আমাকে বেঁচে থাকার শক্তি দিয়েছিল হয়তো…।’

অমলের সাথে আমার প্রথম দেখা হয় ২০০২ সালের জুলাই মাসে। বেশ উদভ্রান্ত চেহারা, উদাসীন দৃষ্টি। যেন আমার দিকে নয়, সে তাকিয়ে আছে আমার পেছনে বহু দূরে কোথাও। আমার মনে হলো সে বাগদাদের রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে, অথবা টাইগ্রীসের পাড়ে, যে দিনগুলোর কথা তার মনে পড়েছিল সেই কালো রাতে, আলোহীন আকাশের নীচে, উত্তাল ঢেউয়ের সাগরে নৌকাডুবির সময়। শুক্রবার, উনিশে অক্টোবর, ২০০১ সাল। মনে করিয়ে দিলাম অমলকে। ‘বিকাল তিনটা বেজে দশ মিনিটে’, সে বলে। ‘আমার মনে আছে, কারণ আমার বন্ধ হয়ে যাওয়া ঘড়িটা এই সময়ই দেখাচ্ছিল’।

অমল তার গল্পটা আমাকে ছাড়া আরো অনেককেই পরে বলেছে। তার এই গল্প বলার মধ্যে একটা অদৃশ্য মিশন ছিল, একটা তাড়াহুড়ো ছিল, যেন তাকে এই গল্প অনেকবার বলতেই হবে। জীবনের শেষ মাসগুলিতে এসে তার এই ব্যগ্রতা আরো বেড়ে যায়ঃ ‘মাই ব্রাদার, আমার মরার পরে তুমি এই গল্পটা আরো অনেককে শুনিও। তাদেরকে শুনিও সেদিন সাগরে মারা যাওয়া মানুষগুলির গল্প, আমার বাবার গল্প, নদীর পাড়ে হাঁটতে হাঁটতে আমার বাবার গাওয়া গানগুলির গল্প। তাদেরকে বলো যে আমি গান ভালোবাসতাম, রঙ ভালোবাসতাম, সিনেমা ভালবাসতাম, আর ভালবাসতাম আমার প্রাণের শহর বাগদাদকে। এখন আমি টেলিভিশনে দেখি ওখানে আকাশ থেকে বোমা পড়ছে। আমি বলি, যেখানে বোমা পড়ছে, ওখানে মানুষ বাস করে। এই শহরের রঙ আগে অন্যরকম ছিল। এখনকার এই ধুসর রঙ আমার অচেনা’।

অমলের মৃত্যুর পাঁচ বছর পরে আমি তাকে দেওয়া আমার কথা রাখতে বসেছি। যতবারই বসি, আমার আশংকা হয় যে, আমি হয়তো এই গল্পের প্রতি সুবিচার করতে পারব না। যে সকল শব্দে অমল তার গল্পটা আমাকে বলেছিল, সে সময় তার চোখে যে আতঙ্কের ছায়া, যন্ত্রনার ছাপ এবং একই সঙ্গে উদাসীনতা দেখেছিলাম, তাকে কি আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব? আমার মনে পড়ে আমি অনেক জায়গায় অমলকে তার গল্প বলতে শুনেছি। মেলবোর্নের উত্তর দিকের বিভিন্ন পাড়ায় তার নানা বাসায়, যেদিকে নতুন আসা রিফিউজিরা ঘর বেঁধেছিল। টার্কিশ লেবানীজ ইরাকী ইরানী অধ্যুষিত সেই সব পাড়ার রাস্তার দুপাশে চোখে পড়ে রঙচঙা হিজাবের দোকান, কাবাবের আস্তানা, অটোম্যান সম্রাজ্যের কথা মনে করিয়ে দেওয়া নানারকম দোকানের নামফলক, আরো কত কি! এ যেন একেকটা ছোটখাটো বাগদাদ, বৈরুত, ইস্তানবুল কিম্বা আঙ্কারা।

শুধু বাসাতে নয়, আমার মনে পড়ে, বেশ কয়েকটি জনসমাগমেও অমল তার এই গল্প বলেছিল। বিভিন্ন স্কুলে, টাউন হলে, মসজিদে-গীর্জায়, ক্যানবেরায় তার মৃত সহযাত্রীদের জন্য আয়োজিত স্মরণসভায়, সিডনীতে একটা ক্যাথেড্রালে। সিডনীর লোকে ঠাঁসা সেই ক্যাথেড্রালে অমলের সাথে দেখা হয়েছিল তারই নৌকায় বেঁচে যাওয়া আরেক সহযাত্রী নারীর। আশেপাশের সরব ভীড়কে উপেক্ষা করেই চলেছিল তাদের দুজনের কান্নাভরা স্মৃতিচারণ। অমল বলছিল, ‘আমি এখনো যেন সাগরে ভাসা সেই লাশগুলোকে দেখি সবসময়।’ একবার মেলবোর্নের এক টাউন হলে দু’হাজার দর্শকের সামনে অমল তার গল্প বলেছিল। সেখানে উজ্জ্বল আলোয় তার মাথার স্কার্ফ জ্বলজ্বল করছিল, আর তার কালো পোশাক যেন এক অন্যরকম দ্যুতি ছড়াচ্ছিল। চোখেমুখে এক কৌতুহলী চঞ্চল কিশোরীর মতন আভা ছড়িয়ে সে বলেছিল, ‘আমি যখন ছোট ছিলাম, আমার স্বপ্ন ছিল গায়িকা হওয়ার, অভিনেত্রী হওয়ার। আমি স্বপ্ন দেখতাম যে, আমি একদিন বিখ্যাত হব। এই যে দেখো, আজকে আমি অস্কার পেয়ে গেলাম।’

আমার মনে পড়ে অমল কিভাবে কেমোথেরাপি নেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে কষ্ট করে নানা জায়গায় তার গল্প বলে বেড়িয়েছিল। এক রাতে সে তার ডাক্তার ও নার্সের সাথে নানা যুক্তিতর্ক শেষে একটা স্মরণসভায় যাওয়ার অনুমতি পেয়েছিল তার গল্প বলার জন্য। মাঝে মাঝে গভীর রাতে আমি অমলের ফোন পেতাম – ভীত, তীক্ষ্ণ কণ্ঠ তার, যেন আচমকা ঘুম থেকে জেগে উঠেছে ভয়ের কোন স্বপ্ন দেখে। আমি জানি, সাগরকে সে বড় ভয় করত, সাগর নিয়ে নানা ভয়ের স্বপ্ন দেখত। ‘মাই ব্রাদার, আমি আগে এমন ছিলাম না। এখন আমি আর ঘুমাতে পারি না। ঘুমালেই আমার ভয় হয় যে আমি আবার সাগর দেখতে পাব। আমার মনে হয় আমি সাগরে কিছু একটা হারিয়ে এসেছি। আমি সাগরে ফিরে যেতে চাই, এবং সাগরকে প্রশ্ন করতে চাই, আমি আসলে কি হারিয়েছি সেখানে? তোমার কি মনে হয়, সাগর আমাকে কিছু বলবে?’

অমল আমাকে বলে যে প্রায় রাতেই সে পানিতে শুয়ে থাকার স্বপ্ন দেখে। সে দেখে যে তার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে, এবং কেউ একজন চীতকার করে বলছে, ফিরে যাও, ফিরে যাও, এ বড় ভয়ানক জায়গা। এখানে তুমি ডুবে যাবে। এখানে তুমি মারা যাবে। অমল ডুবে যেতে থাকে, ভেসে থাকার জন্য সে আশেপাশে তীব্রভাবে হাতড়াতে থাকে। ঘুম ভেঙে গেলে দুঃস্বপ্নের ফিরে আসা ঠেকাতে ঘুম থেকে উঠে বাইরের রাস্তায় হেঁটে বেড়ায়। তারপরে একসময় অন্ধকার ফিকে হয়ে আসে, পাখিরা কোলাহল করে, দিনের আলো ফোটে। ট্রেনে করে মেলবোর্নের শহরকেন্দ্রে যাওয়ার সময় সে আমাকে এইসব স্বপ্নের কথা বলে। ট্রেনে অমল চুপচাপ বসে থাকে, আর গান শোনে। ফ্লিন্ডার্স স্ট্রীট স্টেশনে ট্রেন থেকে নেমে আমরা ইয়ারা নদীর পাড় দিয়ে হাঁটতে থাকি। তখনো তার কানে ইয়ারফোন – উম্মে কুলসুমের গান। শৈশবে তার বাবার হাত ধরে টাইগ্রীসের পাড়ে হাঁটার ছবিটা চোখে পড়ে আমার।

ছবিগুলো অমল মুছতে পারে না। ভুলতে পারে না সাগরের বুকে ঘটা সেই মর্মান্তিক ঘটনার কথা। অমল বলে, সে ছবি আঁকতে চায়। যা দেখেছিল সেদিন, তার ছবি। একটি লাশের উপরে ভেসে সে নিজের জীবন রক্ষা করেছিল; আশেপাশে অনেক বাচ্চার লাশ; পানিতে ঘুমন্ত লাশ। এক মহিলার পাশে তার নবজাত শিশুর লাশ, তখনো নাড়ি দিয়ে মায়ের সাথে বাঁধা। ‘মাই ব্রাদার, আমি সাগরে কিছু একটা হারিয়েছি। ছবির মাঝেই হয়তো আমি সেটা ফেরত পাব।’

শহরের একটা ক্যাফেতে বসে অমল তার গল্পের ঝুলি থেকে আমার জন্য গল্প বের করে। আমি তৈরী হই পারসিয়ান সম্রাট শাহরিয়ারের মতন, এক হাজার এক রাত্রি গল্প শোনার জন্য। ‘আমাদের নৌকাটা যখন ডুবে গেল, আমি তখন সবকিছু পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলাম। আমি যেন এক ক্যামেরা, এক বিন্দুও ভুলি নি। আমি সবাইকে জানাতে চাই, কি ঘটেছিল সেদিন। হয়তো আমি বেঁচে আছি শুধু এই গল্প বলতে, হারিয়ে যাওয়া মা ও বাচ্চাগুলোর স্বপ্নের কথা বলতে, আমার দেশের মানুষগুলির দুর্দশার কথা বলতে। ইরাকের মানুষ কেন দলে দলে ঘর ছেড়েছিল, সে কথা বলতে।’

নৌকার ইঞ্জিন এক পর্যায়ে বন্ধ হয়ে গেলে কেউ একজন সেটা ঠিক করার চেষ্টা করছিল। হঠাত করেই চারদিক থেকে পানি নৌকায় উঠতে শুরু করে, এবং একটা মহিলা ভয় পেয়ে চীতকার দিয়ে উঠেঃ ‘আমরা মরতে যাচ্ছি’। যা ঘটছিল তা কেউই বিশ্বাস করতে পারছিল না। আমি নীচের দিকে তাকিয়ে দেখলাম যে পানি আমার পা স্পর্শ করল। নৌকাতে আমার ছেলেও ছিল আমার সাথে, কিন্তু সেই মুহূর্তে আমি জানতাম না ও কোথায়। আমি আবার নীচের দিকে তাকালাম। পানির উচ্চতা দ্রুত বাড়ছিল। আমার মনে হল, কেউ যেন আমাকে পানিতে ঠেসে ধরে ডুবিয়ে মারতে যাচ্ছে।

আমি চীৎকার করি নি। এমনকি মুখেও কিছু বলি নি। হঠাত চোখের পলকে পুরো নৌকা পানিতে ডুবে গেল। আমি ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলি। পরক্ষণে যখন চোখ খুলি, তখন আমি পানির অনেক নীচে। আমার আশেপাশে অনেক বাচ্চা ভাসছিল কিম্বা ডুবছিল। আমি সাঁতার জানতাম না। নিঃশ্বাস বন্ধ করে ছিলাম, যতক্ষণ পারা যায়। এর পরে আমি যখন পানির উপরে ভেসে উঠলাম, নরকের দরজা যেন খুলে গেল। মাই ব্রাদার, তুমি কল্পনাও করতে পারবে না। ছোট ছোট বাচ্চারা সমুদ্রের পানি খাচ্ছিল, চীৎকার করছিল আর ডুবে যাচ্ছিল একে একে। এক মহিলাকে চীতকার করতে শুনলাম, ‘হে ঈশ্বর, আমি মারা যাচ্ছি’। একজন পুরুষের গলা শুনলাম, ‘আমার বউ, বাচ্চা সবাইকে হারালাম’। আরেকজন মহিলা বলছিল, ‘আমার বাচ্চা ডুবে গেল, আমার স্বামীও ডুবে গেল, আমার আর বেঁচে থাকার সাধ নাই’। আরেকজনকে বলতে শুনলাম, ‘হে ঈশ্বর, আমার ছোট ছেলেটাকে বাঁচাও, তাকে সাহায্য করো, নাহলে সে ডুবে মারা যাবে’। এক পুরুষকে বিলাপ করতে শুনলাম, ‘আমার মেয়েগুলি সবই তো ডুবে গেল’। আমি ভাবছিলাম, নরক কি এর চেয়ে খারাপ কিছু? চারিদিকে মৃত্যু আর চীৎকার। কি হয়েছে আমাদের? আমরা কোথায়? আমি ভাবলাম, না, মরলে আমার চলবে না, আমি একজন মা। আমার ছোট ছেলেটা আশেপাশে কোথাও এই পানিতেই বাঁচার চেষ্টা করছে, আমার আরেক ছেলে আমার জন্য ইরানে অপেক্ষা করছে, আমার মেয়ে তার স্বামী ও চার সন্তানসহ জর্ডানে অপেক্ষা করছে। আমি মারা গেলে ওদের ভবিষ্যতের কি হবে? আমাকে বাঁচতেই হবে, কারণ আমি আবার আমার বাবার হাত ধরে টাইগ্রীসের তীরে হাঁটতে চাই।

আমি চারপাশে তাকালাম। অসংখ্য মানুষ, চোখে সবার ভয়ের দৃষ্টি। সবাই বাঁচার চেষ্টা করছে। একটা মহিলা তার নবজাত বাচ্চাসহ ভাসছে। সে গর্ভবতী ছিল। তার স্বামী তার জন্য অস্ট্রেলিয়ায় অপেক্ষা করছে। সুমাত্রায় তার সাথে আমার অনেক কথা হয়েছিল, অস্ট্রেলিয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করার আগে। আহারে, বেচারা জানবে না তার স্ত্রী ও বাচ্চা এখন কোথায়! আরেকটা কম বয়সের গর্ভবতী মেয়েকেও দেখলাম সাগরে তার বাচ্চাসহ ভাসছে। তারা মনে হয় ঘুমিয়ে গেছে, স্বপ্ন দেখছে। নাকি আমিই স্বপ্ন দেখছি?

আমার আশেপাশে অনেক বাচ্চাকে দেখছি। জাকার্তা থেকেই আমি এদের বেশ কয়েকজনকে চিনি। ফেরেশতার মত একেকটা চেহারা, সব সাগরে ঘুমিয়ে আছে। আমার মনে হলো ওরা যেন পাখি, এখনি উড়ে যাবে অন্য কোথাও। এগারো-বারো বছরের একটা মেয়ে ভাসছে আমার খুব কাছে, ওর চোখদুটো খোলা। সেই চোখদুটো যেন আমাকে প্রশ্ন করছে, ‘কি অপরাধ করেছিলাম আমি?’ আমি বলি, আহা রে বেচারী!

একটা বড় ঢেউ এসে আমাদের উপর দিয়ে বয়ে গেল, আমি নোনা পানি গিলতে শুরু করলাম। আমার মনে হল এবার আমি মারা যাচ্ছি। ইতোমধ্যে আরেকটা ঢেউ এসে আমাকে পানির আরো গভীরে নিয়ে গেল। আমি সর্বশক্তি দিয়ে পানি থেকে উপরে ভেসে উঠার চেষ্টা করতে থাকলাম। উপরে যখন উঠলাম, আমি আমার ছেলেকে দেখতে পেলাম। আমজাদ। ষোলো বছর বয়স ওর। আমজাদ ভয়ে আতংকিত হয়ে একটা কাঠের টুকরা ধরে ভেসে থাকার চেষ্টা করছে আমার থেকে বেশ কিছুটা দূরে। আমি ওর কাছে যেতে পারছিলাম না। আমাকে দেখে ও কাঁদতে শুরু করল, ‘মা, আমরা তো ডুবে মারা যাচ্ছি’। আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না ওর কথা। আমার মনে হচ্ছিল যে আমি দুঃস্বপ্ন দেখছি। আমজাদ চীতকার করে বলছে, ‘মা, তুমি এখানে এসে আমাকে বাঁচাও। আমি তো আর সাঁতরাতে পারছি না’। ‘মা, আমাকে মাফ করে দাও, আমি মনে হয় তোমাকে কষ্ট দিয়েছি’। ‘মা, আমার কাছে আসো, আমি তোমাকে চুমু দিই’।

ঠিক সেই মুহূর্তে আমার সামনে একটা মহিলার লাশ ভেসে আসল, যার গায়ে একটা লাইফ জ্যাকেট জড়ানো ছিল। আমার মনে পড়ল ছোটবেলায় টাইগ্রীস নদীর তীরে আমার বাবার বলা সেই কথাটা, লাশ ভেসে থাকে। আমি সেই মহিলার লাশটা ধরে ভেসে থাকলাম। আমি এক হাতে সেই লাশটি ধরে থেকে আরেক হাতে সাঁতার দিয়ে আমজাদের কাছে গেলাম। আমজাদ মৃত মহিলার লাইফ জ্যাকেট খুলে আমার গায়ে জড়িয়ে দিল। এভাবে সে আমার জীবন বাঁচাল। এরপরে সে আমাকে একটা চুমু দিল। ইতোমধ্যে একটা বড় ঢেউ এসে তাকে আর আমাকে আলাদা করে দিল। আমজাদ বলতে থাকল, ‘মা, আমি তোমাকে ভালবাসি। মা, আমরা মনে হয় মারা যাচ্ছি। মা, তোমার সাথে বেহেশতে গিয়ে দেখা হবে।’ এর পরেই আমি আমজাদকে হারিয়ে ফেললাম সেই বিশাল সাগরে।

ঢেউয়ে ভেসে আমি অন্য এক জায়গায় চলে এলাম, যেখানে অনেক মানুষ তাদের জীবনের জন্য লড়ছিল আর চীতকার করছিল, ‘ঈশ্বর, সাহায্য করো’। কিছু বাচ্চাও পানিতে ভেসে ছিল এটা-সেটা ধরে; সবাই ভীত সন্ত্রস্ত ও দুর্বল। তাদের চোখেগুলো সাহায্যের আকুতি জানাচ্ছিল নীরবে। তারা জানত তাদের ভাগ্যে কি ঘটতে চলেছে। আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়, এই শিশুগুলির জন্য এত বড় নিষ্ঠুরতা অপেক্ষা করে ছিল। দেখা ছাড়া আমার আর কিছুই করার ছিল না। আমি শুধু দেখছিলাম আর শুনছিলাম। চারিদিকে সীমাহীন কোলাহল। পেট্রোল, বিস্কুটের প্যাকেট, পাউরুটি, স্যুটকেস, কমলা ভেসে বেড়াচ্ছে আশেপাশে। ‘বাঁচাও, বাঁচাও’ চীতকারে কান পাতা দায়।

ঘন্টাখানিক পরে সবকিছু অনেক শান্ত হয়ে এল। আমার ধারণা হল যে, কেউই হয়তো আর বেঁচে নেই, একমাত্র আমি ছাড়া। উপরে আকাশ, নীচে সাগর, মাঝে এই অসংখ্য লাশের মাঝে আমি একা। নিজেকে প্রশ্ন করলাম, কেন আমি এখনো বেঁচে আছি? নিজের ভেতর থেকেউ উত্তর এল, কারণ আমি দুনিয়াকে জানাতে চাই, কি ঘটেছে এখানে। এই বাচ্চাগুলো আর তাদের স্বপ্নগুলোর কথা আমি সবাইকে বলতে চাই। যে মানুষগুলো নতুন করে জীবন শুরু করতে চেয়েছিল, তাদের অপমৃত্যুর কথা আমি সবাইকে বলতে চাই।

যে মেয়েটির লাশ ধরে আমি ভেসে ছিলাম, আমি তার সাথে কথা বললাম। আমি বললাম, ‘বোন আমার, আমাকে মাফ করে দিও। আমি হয়তো তোমার শরীরে ব্যাথা দিচ্ছি, তোমাকে স্পর্শ করছি। সাগরে তোমার কি হারিয়েছে? স্বামী? বাচ্চা? তোমার আত্না? জীবন?’ আমি মেয়েটির মুখের দিকে তাকাতে পারছিলাম না। আমি চেয়েছিলাম সে যেন আমাকে ক্ষমা করে দেয়। আমার নিজের জন্য খুব লজ্জা হচ্ছিল। সাগর ইতিমধ্যে আবার বেশ উত্তাল হয়ে উঠেছে এবং বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আমি সেই মেয়েটিকে বলতে থাকলাম, বোন, তুমি আমার সাথে থাকো। আমাকে মাফ করে দাও।

রাত হয়ে আসছিল। এক সময় এত অন্ধকার হয়ে এল যে আমার নিজের হাতটাও দেখা যাচ্ছিল না। অনেক লাশ এবং মাছ আমার চারপাশে। আমি পেট্রোলের গন্ধ পাচ্ছিলাম। একটু দূরে দেখলাম একটা কালো বিশালাকায় মাছ বা অন্য কিছু পানি ছিটাচ্ছে। তিমি বা অন্য কোন মাছ হবে হয়তো। তারপরে আমি হঠাত পানির উপরে আলো্র রশ্মি ভেসে বেড়াতে দেখলাম। আমি আলোর উৎসের দিকে সাঁতরে যাওয়ার চেষ্টা করলাম। খানিক পরে আলো এসে আমার উপরে পড়ল, সেই আলোয় আমি দেখলাম আমার পাশে একটা হাঙ্গর ঘুরে বেড়াচ্ছে। সম্ভবত পেট্রোলের গন্ধের কারণেই হাঙ্গর আমাকে আক্রমণ করে নি।

আলো দেখার পরে আমি বুঝলাম যে, সাগরে আমি একা জীবিত নই। অনেকেই সেই আলোর দিকে সাঁতার কেটে যাওয়ার চেষ্টা করছে এবং ‘বাঁচাও, বাঁচাও’ চীতকার করছে। আমি একটু কাছে এসে দেখলাম যে, একটা নৌকা থেকে আলোটা আসছিল। আমার আশেপাশে কয়েকটা ছেলে সাঁতার কাটছিল। ওরা বলল, ‘আমরা ওই নৌকার দিকে যাচ্ছি, ওরা হয়তো আমাদেরকে সাহায্য করতে এসেছে। তুমি আমাদের সাথে আসো’। আমরা সবাই একসাথে যেতে থাকলাম, আর চীতকার করতে থাকলাম। নৌকা থেকে আলো এসে আমার চোখে লাগছিল, এবং আমি একটা জাহাজের ভেঁপু শুনতে পেলাম। আমার মনে হলো, এবারে হয়তো আমরা উদ্ধার পাব। কিন্তু নৌকার খুব কাছে এসে পড়ার পর আমি দেখলাম যে, নৌকাটা দূরে চলে যাচ্ছে। ওরা আমাকে বা কাউকেই উদ্ধার করল না। অনেককে দেখলাম হতাশ হয়ে তাদের শেষ সম্বল কাঠের টুকরা বা এটা ওটা ছেড়ে দিয়ে ডুবে যেতে। আমি আবারো একা হয়ে পড়লাম সেই উন্মত্ত সাগরে। ভয়ানক ঠান্ডার মধ্যে বৃষ্টি, আর দম বন্ধ করা অন্ধকার। আমি মনে মনে মৃত্যুর দূতকে ডাকলাম। সে ছাড়া আর কেই বা আমাকে উদ্ধার করতে পারে এই নরকযন্ত্রণা থেকে?

একটানা এতখানি বলে অমল হাঁপায়। চারিদিকে ভয়ের দৃষ্টিতে তাকায়। সে আর সাগর নিয়ে কথা বলতে চায় না। সে অন্য কিছু নিয়ে কথা বলতে চায়। আমজাদের কথা, তার বড় ছেলের কথা, তার মেয়ের কথা, তার নাতি-নাতনিদের কথা। সাগরের স্মৃতি তাকে কাতর করে ফেলে, অস্থির করে ফেলে, ভীত করে ফেলে।

সপ্তাহখানেক পরে আমি আবার তার কাছে যাই, তার নতুন বাসায়। সে বলে, আমাকে দোলমা খাওয়াবে – ইরাকে দোলমা তার খুব প্রিয় খাবার ছিল। প্রতি শুক্রবারে সে বাসায় দোলমা রান্না করত। আমাকে রঙ চা এবং বাকলাভা খেতে দিয়ে অমল সিডি থেকে উম্মে কুলসুমের গান ছেড়ে দিল। এর পরে সে রান্নাঘরে দোলমা বানাতে গেল। আমি উম্মে কুলসুমের গান শুনতে শুনতে আলিফ লায়লা দেখার স্মৃতি রোমন্থন করছিলাম। আমার মনে পড়তে থাকে ইতিহাসের আদি উতসস্থল, মেসোপটেমিয়ার কথা – টাইগ্রীস-ইউফ্রেটিস-বাগদাদের কথা। অমল বাগদাদে তাদের আগের জীবনের গল্প বলে। যেন কোন এক সূদুর অতীতের ঘটনা সে সব। তার সাথে আমিও মনে মনে বাগদাদের অলিগলিতে ঘুরতে থাকি।

বাগদাদ শহরের পুরানো এলাকায় অমল ও তার পরিবার বাস করত। আট ভাই ছিল তার। ইঞ্জিনিয়ার বাবা ছুটির দিনে একমাত্র মেয়েকে নিয়ে ঘুরতে বেরুতেন। কখনো শহরে, কখনো নদীর পাড়ে। নদীর পাড়ে তাজা মাছ বিক্রী হতো, সেগুলো কখনো কখনো কিনত তারা। অনেক মুখরোচক খাবারের দোকানও বসত পথের দুপাশে। আমার অনেক স্বপ্ন ছিল সে সময় – বড় হয়ে একটা কিছু করব। হাইস্কুল শেষে বিজনেস স্কুলে ভর্তি হলাম। ইরাকের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে আমি কাজ করেছি আট বছর। আমার স্বামী আব্বাস তার নিজের ব্যবসা দাঁড় করানোয় ব্যস্ত। একটা সুখের জীবন ছিল আমাদের। কিন্তু এর পরে আসে ইরাক-ইরান যুদ্ধ। আমাদের দুঃখের শুরু হয় সেই সময়। ভাই ভাইয়ের সাথে যুদ্ধে কখনো জিততে পারে? বাগদাদ তখন এক বিপদজনক নগরীতে পরিণত হয়। ইরাকের অর্থনীতি খুব খারাপ হয়ে যায়। ইরাকে খাবার ও ওষুধের সংকট দেখা দেয়। অনেকের চাকুরী চলে যায়। সেই সময় ইরাকে নিত্য প্রয়োজনীয় খাবারেরও সংকট দেখা দেয়, কারণ ইরাক তেল বিক্রী করতে পারছিল না আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা ছিল। মানুষ তার স্বাধীনতা হারাচ্ছিল। স্কুল, কলেজ সব বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।

মাই ব্রাদার, আমি তোমাকে জানাতে চাই কেন ইরাকের মানুষ সে সময় দেশ ছাড়তে শুরু করেছিল। কেন আমি বা আমরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নৌকায় উঠেছিলাম, ছোট ছোট বাচ্চাসহ। কেন আমার ষোল বছরের আমজাদকে নিয়ে আমি সাগরে নেমেছিলাম। আমরা ভাল থাকতে চেয়েছিলাম, স্বাধীন জীবন চেয়েছিলাম। অমল সাদ্দাম হুসেইনের কথা বলে। সেই অন্ধকার সময়ের কথা বলে। ১৯৮০ সালে সাদ্দাম এসেই ইরানের সাথে যুদ্ধ শুরু করে, বাগদাদ ভেঙে পড়ে, আমার স্বামীকে যুদ্ধে যেতে বাধ্য করা হয়। আমাদের জীবনে অন্ধকার নেমে আসে। আমাকে বলা হয়, তোমাকে চাকুরী ছাড়তে হবে। আমি সে সময় খুবই হতাশ হয়েছিলাম, কারণ এই চাকুরীটি পেতে আমাকে কম কষ্ট করতে হয় নি।

যুদ্ধের আগে আমার সব ছিল। আমার কাজ ছিল, আমার সংসার ছিল। কারো সাথে যুদ্ধ করার দরকার ছিল না আমার। যুদ্ধ এসে যেন সব কেড়ে নিয়ে গেল। দশ বছর যুদ্ধ চলল। যুদ্ধ শেষে আমার স্বামী ঘরে ফিরে এল। সে খুব ভাগ্যবান ছিল; যুদ্ধে তার কোন ক্ষতি হয় নি। কয়েক লাখ লোক মারা গিয়েছিল সেই যুদ্ধে। আমরা আলাপ করছিলাম, কিভাবে আবার নতুন জীবন শুরু করা যায়। কিন্তু বিধি বাম, সাদ্দাম আবার যুদ্ধ শুরু করল। এবার কুয়েতের সাথে। আবারো সেই না-খাবার, না-ঔষধ দিনগুলো শুরু হল। স্কুল কলেজ আগের মতই বন্ধ থাকল। আমার দেশ ছিল এক তীব্র হতাশাময় দেশ। সেখানে কিছুই ছিল না করার মত। আমার কাজ নেই, সংসার নেই, আশা নেই। আমার ভাই সাদকে সাদ্দামের লোকেরা মেরে ফেলেছিল, কারণ সে কুয়েতে যুদ্ধে যেতে চায় নি। আমার ভাই বলেছিল, কুয়েতের লোকেরা আমার ভাই, ওদের সাথে যুদ্ধ করতে পারব না আমি। আমার ভাইকে মারার পরে পুলিশ আমার বাবাকে ফোন করে লাশ নিয়ে যেতে বলেছিল। বাবা গিয়ে রক্তমাখা লাশ আনার পরে সাদের পকেটে একটা চিরকুট পাওয়া যায়, যাতে লেখাঃ আমার ছেলেমেয়েগুলোকে তোমরা দেখে রেখো।

আমার আরেক ভাই বাহির ছিল বিশ বছরের তরুন। আমেরিকার সাথে যুদ্ধে ও মারা যায়। বসরায় ইরাকী নিরাপত্তা বাহিনীতে কাজ করার সময় তার উপরে আমেরিকানদের বোমা এসে পড়ে। এর পরে আমি হারাই আমার এক চাচা এবং চাচাতো ভাইকে। মনে হচ্ছিল, আমাদের পরিবারের কোন পুরুষ মানুষ আর জীবিত থাকবে না। কয়েকদিন পরে আমার স্বামীর এক ভাই, সালেহ, পুলিশের হাতে মারা যায়। সে সাদ্দামের অপশাসনের বিরুদ্ধে কারবালাতে একটা বিদ্রোহের সাথে যুক্ত ছিল। সেটা ১৯৯১ সালের কথা। তার লাশ আর পাওয়া যায় নি। ১৯৯৫ সালে আমার স্বামীর আরেক ভাই গুম হয়ে যায়। তাকেও কারবালার সেই বিদ্রোহের ব্যাপারে সন্দেহ করা হত। এর পরে পুলিশ আমার স্বামীকে খুঁজতে শুরু করে। সে গ্রেপ্তার হয়, এবং জেলখানায় পুলিশ তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। পুলিশ তাকে প্রশ্ন করে, তোমার ভাইদের বিদ্রোহী কার্যকলাপের ব্যাপারে তুমি কি কিছু জান? তোমার ভাইয়েরা কেন এই দেশদ্রোহী কাজে যোগ দিয়েছিল? তাদের সাথে আর কে কে ছিল? আমার স্বামী বলেছিল যে, সে এসবের ব্যাপারে কিছু জানত না।

পুলিশ তাকে প্রায় ২ মাস জেলে রাখে। এই সময় তাকে ইলেকট্রিক শক দেওয়া হয়েছিল, এবং আরো নানাভাবে নির্যাতন করা হত। জেল থেকে বাসায় আসার পরে তাকে আবার একদিন ডেকে পাঠানো হয় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য। আমার স্বামী ভয় পায়। আব্বাস বলে যে, ‘এবারে ওরা আমাকে মেরে ফেলবে। তাড়াতাড়ি এই দেশ থেকে পালাতে হবে আমাদেরকে।’

এক রাতে আব্বাস ফোন করে আমাকে বলে যে, সে বাসায় আসবে না। আমি জিজ্ঞেস করি, কেন? সে বলে, ‘আমি আমার এক বন্ধুর বাসায় লুকিয়ে আছি। পুলিশ আমাকে খুঁজছে, চারপাশে গোয়েন্দা লাগিয়েছে। তোমরা সাবধানে থাকো।’ বড় কঠিন সময় ছিল সেটা – কে যে বন্ধু আর কে শত্রু, কিছুই ঠাহর করা যায় না। সেই রাতেই আমাদের দরজায় পুলিশ নক করে গভীর রাতে, আমার স্বামীর খোঁজে। আমি কিছু না বলাতে তারা বাসায় তল্লাশী চালায়। আমার স্বামীকে না পেয়ে তারা ফার্নিচার ভাঙচুর করে, গালাগালি করে এবং চীতকার করে। আমার বাচ্চারা ভয়ে কান্না শুরু করে দেয়। পুলিশ যাওয়ার সময় আমাকে বলে যায়, পরের দিনই আমাকে নিজে থানায় যেতে হবে। আমি বলি, আমি আমার স্বামীর খোঁজ জানি না। পুলিশ আমাকে সেই রাতেই থানায় নিয়ে যায়, প্রায় সারারাত জিজ্ঞাসাবাদ করে।

পরের দিনই আমি বাসা থেকে বের হই, আমার ছেলেমেয়ে এবং কিছু কাপড়চোপড় নিয়ে। প্রচণ্ড আতংকের মধ্যে আমি আমার বাবার বাসায় গিয়ে হাজির হই এবং কয়েকদিন সেখানেই থাকি। আমার ছেলে আমজাদ বলে যে, সে পুলিশকে নিয়ে নানা ভয়ের স্বপ্ন দেখেছে।

ইতোমধ্যে আমার স্বামী এবং বড় ছেলে আহমেদ ইরানে পালিয়ে গেছে। কিছু দালালকে টাকাপয়সা দিয়ে তারা পাহাড়ী সীমান্ত পার হয়েছিল। ইরান থেকে আব্বাস আমাকে ফোন করে জানায় যে, আমাকেও আমজাদকে সাথে নিয়ে ইরানে যাওয়ার জন্য তৈরী হতে হবে। দালাল আমাকে বলে, সাথে কিছুই নেওয়া যাবে না – কোন কাপড়চোপড় না, আসবাবপত্র বা বাক্স না, কোন ছবি না, ক্যামেরা রেডিও কিছুই না। আমি আমজাদকে সাথে নিয়ে এভাবেই একদিন আমার পরিবারকে বিদায় জানিয়ে পথে নামলাম। আমার মা খুব অসুস্থ ছিল সে সময়। তার একটা স্ট্রোক হয়েছিল এবং সে হাঁটাহাঁটি করতে পারত না। তার ঔষধ এবং ভাল পথ্যাদির প্রয়োজন ছিল, কিন্তু ইরাকে সে সময় শুধুমাত্র বেঁচে থাকার মতন খাবার পাওয়াটাই অসম্ভব ব্যাপার ছিল। মা’কে এই অবস্থায় ফেলে আসতে আমার মন চাইছিল না। কিন্তু কি করব, নিজের সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে আমাকে এই কঠিন সিদ্ধান্ত নিতেই হল। এক রাতে বের হলাম আমি। পেছন ফিরে আমি আমার বাসাটাকে দেখলাম। নিজেকে প্রশ্ন করলাম, আর কখনো কি আমার নিজের কোন বাসা হবে? আমি কি আবার সংসার করতে পারব স্বামী-সন্তান নিয়ে?

জ্ঞানীদের মতে, অনিশ্চয়তা মৃত্যুর চেয়েও খারাপ দশা। প্রাচীন পুরানে অনিশ্চয়তাকে বলা হোত স্বর্গ ও নরকের মধ্যবর্তী অঞ্চল – যেখানে ঘরহারা আত্নাগুলো ঘরের সন্ধানে তীর্থের কাকের মত বসে থাকে। অনিশ্চিয়তায় থাকা মানে নো-ম্যানস-ল্যান্ডে থাকা, দোসীমানায় থাকা, না-এস্পার-না-ওস্পার অবস্থায় থাকা, যা জেলখানায় থাকা বা মরণের চেয়েও খারাপ। ঘরহারা অনিশ্চিত অবস্থায় ভবিষ্যত বলে কিছু থাকে না, থাকে শুধু এক চলমান বর্তমান আর এক বিশালাকায় অতীত। এ রকম পাহাড়সম অনিশ্চয়তা হাতে করে একদিন অমল বাড়ি ছাড়ল, পঞ্চাশ বছরের চেনা বাগদাদকে ছাড়ল। তার শৈশব, তার সারাজীবন, তার স্বপ্ন-বেদনা সবই ছিল এই বাগদাদে। অথচ আজ তাকে চোরের মতন পালিয়ে যেতে হচ্ছে। আপাতত গন্তব্য পুলিশ চেকপোস্ট এড়িয়ে উত্তরে কুর্দিস্তানের পাহাড়ের দিকে যাওয়া। এইসব পাহাড়ী এলাকায় রাতারাতি বসতি গড়ে ওঠে দেশত্যাগীদের সাময়িক প্রয়োজনে, আবার সেগুলো ভোজবাজির মত উধাও হয়ে যায় নিমিষেই। অমল এরকম একটা বস্তিতে এসেও সাদ্দামের ভয়কে মন থেকে তাড়াতে পারছিল না। তার কেবলি মনে হতে থাকে, এই বুঝি সাদ্দামের লোকেরা তাকে ধরতে এল। ইরানের সীমান্তের কাছাকাছি ইরাকী কুর্দিস্তান এলাকার শহর সুলাইমানিয়াতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত তার কেবল এই এক ভাবনা মনে – যদি ধরা পরে যাই? সুলাইমানিয়াতে পৌঁছে অমল ও আমজাদ যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার ফুরসত পেল। তবে এখানে অনেক মানুষের ভীড়ে মা-ছেলের জায়গা হলো একটা ছোটমতন ঘরে, যেখানে বিদ্যুৎ নেই, পানি নেই, গ্যাস নেই, চুলা নেই। বাগদাদে নিজেদের প্রশস্ত ঝকঝকে বাড়ির কথা মনে পড়ছিল তাদের। তারপরেও পরিস্থিতির বিচারে এই কুড়েঘরটিকে তাদের স্বর্গের সিঁড়ি মনে হল, কারণ এখানে থেকে শক্তি সঞ্চয় করেই তারা তাদের ভবিষ্যতের পথে পা বাড়াবে।

অনেক বছর পরে, মেলবোর্নের এক হাসপাতালে চেতনানাশক ওষুধ দিয়ে ডাক্তারেরা যখন তার শরীরে একটা অপারেশান করছিল, তখন একদিন অমল স্বপ্ন দেখে যে, সে ইরাকের কুর্দিস্তান এলাকার পাহাড়ে একটা গুহায় আশ্রয় নিয়েছে। এক শান্ত সৌম্য গুহায় সে সাদা কাপড় পরিহিত। সেখানকার সবকিছুই যেন সাদা রঙ দিয়ে তৈরী। অনেক শান্তি আর অফুরন্ত অবসর ছিল তার। হঠাত তার ছেলে এসে চীতকার করে বলে, ‘মা, ওঠো, আমাদেরকে তাড়াতাড়ি পালাতে হবে। দৌড় দাও!’ গুহার শান্ত পরিবেশ থেকে অন্য কোথাও যেতে তার মন চাইছিল না। কিন্তু ছেলে তার হাত ধরে টেনে হিঁচড়ে গুহার ভেতর থেকে বের করে নিয়ে আসে। ঠিক এই সময়েই অমলের ঘুম ভেঙে যায়, কারণ তার অপারেশনও শেষ হয় একই সময়ে। অমলের স্বপ্নগুলো যেন তার স্মৃতিরই ফিরে আসা। সে যখন হাসপাতালে ভর্তি হয়, তখন আমি তাকে দেখতে গেলে সে আমাকে তার ইরাকী কুর্দিস্তানের সেই অস্থায়ী বসতির কথা বলেছিল। সে বলেছিল, তার বড় ছেলে ও স্বামী ইরান থেকে সেখানে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, যাতে অমল ও ছোট্ট আমজাদ সেই বিপদসংকুল পথে কোন বিপদে না পড়ে।