জেলখানায় বসে অসমাপ্ত আত্নজীবনীতে বাঙালির চরিত্রের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছেন, ‘আমাদের ভাষাতে একটা বিশেষ শব্দ আছে, যা অন্য অনেক ভাষায় নেই। পরশ্রীকাতরতা। পরের শ্রী দেখে যে কাতর হয়, তাকে ‘পরশ্রীকাতর’ বলে। ঈর্ষা, দ্বেষ সকল ভাষাতেই পাবেন, সকল জাতির মধ্যেই কিছু কিছু আছে, কিন্তু বাঙালিদের মধ্যে আছে পরশ্রীকাতরতা। ভাই ভাইয়ের উন্নতি দেখলে খুশি হয় না’। ১৮৮৯ সালে তরুন রাসেল লিখেছিলেন, ‘একটি ভাষা কোন ধরনের ধারণাগুলোকে ভালভাবে প্রকাশ করতে পারে, তা থেকে আমরা সেই জাতির চরিত্র সম্পর্কে ধারণা পেতে পারি। উদাহরণস্বরুপ, ফরাসীতে ‘স্পিরিট’ বা ‘স্পিরিচুয়াল’ শব্দগুলো আছে, অথচ এই ধারণাগুলো ইংরেজীতে ব্যাখ্যা করতে কষ্ট হয়। যেখান থেকে আমরা উপসংহারে পৌঁছুতে পারি, এবং বাস্তবে এই দুই জাতিকে পর্যবেক্ষণের দ্বারাও নিশ্চিত হতে পারি যে, ইংরেজদের চেয়ে ফরাসীরা বেশি স্পিরিচুয়াল’।

কোন ভাষায় কোন শব্দ আছে, তা দিয়ে যেমন সেই জাতির চরিত্রের ব্যাপারে কোন স্থির সিদ্ধান্তে আসাটা দুষ্কর, তেমনি কোন ভাষায় কোন শব্দের ব্যবহার নেই, তা দিয়েও সেই জাতির চরিত্র বোঝা দায়। কৃতঘ্ন বা পরশ্রীকাতরতা শব্দটা ইংরেজীতে নেই বটে, কিন্তু ইংরেজীভাষীরা যে এসব জিনিস বোঝে না, এসবের অভিজ্ঞতা লাভ করে না বাস্তবজগতে, সেটা বলা যায় কি? উলটো উদাহরণ দিইঃ দার্শনিক সিসেরো বলেছিলেন, গ্রীকদের ভাষায় ল্যাটিন শব্দ ineptus এর কোন প্রতিশব্দ নেই (English: having no sense of what is fitting/impertinent/tactless)। সিসেরো ব্যাখ্যা দিলেন – এই শব্দের অনুপস্থিতি এটাই প্রমাণ করে যে, গ্রীকদের মধ্যে এই দোষটা এত বেশিমাত্রায় বিদ্যমান ছিল যে, তারা সেটা খেয়াল পর্যন্ত করত না।

বাংলাভাষায় সেক্সের কোন সহজলভ্য প্রতিশব্দ নেই – যা আছে তা হয় সরাসরি চ-বর্গীয়, যা শুনলে আমরা লজ্জায় লাল হই, অথবা সংস্কৃত কলেজের বারান্দা থেকে আমদানী করা কাব্যময় শব্দাবলী, যেমন রমণ/মৈথুন/রতিক্রিয়া/যৌনকর্ম ইত্যাদি। এ থেকে কি আমরা এই সিদ্ধান্তে আসব যে, সেক্স আমাদের সমাজে কোন আলোচ্য বিষয় নয়, নাকি সেক্সের সাগরেই আমরা ডুবে আছি? নাকি, আমরা আসলে সেক্সের ব্যাপারে বাস্তব জগতেও হয় চ-বর্গীয় নয় রমণ/মৈথুনের মতন অলংকারময়, এই বাইনারীতেই আবদ্ধ?

অনেকের কাছে শুনি ‘ফ্রি সেক্স’ নামক একটা ধারণার কথা। অনেকদিন বিদেশে থাকি, সেই সুবাদে দেশের অনেকেই জানতে চান, আসলে এই ফ্রি সেক্স কি বস্তু? সম্প্রতি বাংলাদেশ থেকে আসা কয়েকজন ক্রিকেট সাংবাদিক সম্ভবত এই ফ্রি সেক্সের চোরাবালিতেই আটকে গিয়ে এখন অস্ট্রেলিয়ার জেলখানায় কাল কাটাচ্ছেন। মেলবোর্নে এমন একজন সাংবাদিকের সাথে আমার কথা হলো পেশাগত কারণে – তিনি আইনী ঝামেলায় জড়িয়ে যাওয়াতে তার সেই ফ্রি-সেক্সের ঘোর অবশ্য ততক্ষণে কেটে গেছে। তিনি আমাকে বললেন, ভাই, এই দেশে মেয়েরা এত খোলামেলা পোশাকে ঘোরাফেরা করে, ক্লাবে/পাবে বসে ওয়াইন খায়, অথচ সামান্য এক গায়ে হাত দেওয়া নিয়ে এত রিএক্ট করবে আমি ভাবিনি। আমি তাকে কিছু বলি না। মনে মনে বলি, ব্যবহারিক শিক্ষাই আসল শিক্ষা। ফ্রি সেক্স কাকে বলে, শিখে যাও বাছা।

আশা করি বিশ্বকাপ ক্রিকেটের কথা অনেকেই এখনো ভোলেন নি। এই বিশ্বকাপ ছিল বাঙালির বড় সাধের বিশ্বকাপ, যেখানে তারা অস্ট্রেলিয়ান মিডিয়াতে ব্যাপক কাভারেজ পেয়েছে। এই সব কাভারেজের প্রায় পুরোটাই পজিটিভ, শুধুমাত্র একটা যৌন অপরাধের খবর ছাড়া। সেই যে সাংবাদিক পেয়ার রহমানের সামান্য ভুলবুঝাবুঝির খবরটা…মনে পড়ছে তো? আমাদের অবশ্য এই সব ব্যাপারে স্মৃতি খুবই দুর্বল। অনেক সহজে ভুলে যাই। মনে করিয়ে দিচ্ছি –

শিরোনামঃ ‘ইভটিজিং’-এর অভিযোগে ইন্ডিপেন্ডেন্ট টিভির সাংবাদিক পেয়ার রহমান অষ্ট্রেলিয়ায় গ্রেফতার

খবরঃ বিশ্বকাপ ক্রিকেট কাভারে করতে অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে ‘ইভটিজিং’-এর অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছেন ইন্ডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশনের সাংবাদিক পেয়ার রহমান। অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার পথে বিমানে এক কোরিয়ান নারীকে উত্যক্ত করেছিলেন তিনি। এরই জেরে সিডনি এয়ারপোর্টে নামার সঙ্গে সঙ্গে তাকে ধরে নিয়ে গেছে অস্ট্রেলিয়া পুলিশ। **** তবে ইভটিজিংয়ের বিষয়টি অস্বীকার করে সংশ্লিষ্ট টিভি চ্যানেলটির কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ঘটনাটি ইচ্ছাকৃত নয়। ঘুমের ভেতর অনিচ্ছাকৃতভাবে ওই নারীর শরীরে সাংবাদিকের হাত পড়ে। এতে ভুল বুঝাবুঝি তৈরি হয়। স্থানীয় দূতাবাস বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

আসল ঘটনা হল, এটা ইভ-টিজিং ছিল না, ছিল ধর্ষণের চেষ্টা, এবং সজ্ঞানকৃত। অস্ট্রেলিয়ার পুলিশ যখন কাউকে গ্রেফতার করে, এবং বিমান থেকে সরাসরি জেলে ভরে, সেখান থেকেই অপরাধের মাত্রা আঁচ করা যায়। এখানে পেয়ার রহমানের পক্ষে সংশ্লিষ্ট টিভি চ্যানেলটির বক্তব্যটি লক্ষণীয় – তারা একটা গালগল্প বানিয়েছেন দেশী কায়দায়। বাংলাদেশের কোন বিমানে এই ঘটনা ঘটলে তারা হয়তো ওই মেয়ের পোষাক-আষাকের উপরেই দায় চাপিয়ে দিতেন। সাংবাদিক সমিতি হয়তো তাদের একজন নিরীহ সদস্যের চরিত্রে কালিমা লেপনের জন্য কোন কোন অসাধু মহলকে দায়ী করতেন। সেই মেয়েটির ছবি আসতো পত্রিকায়, সে সমাজের চোখে নিগৃহীত হতো।

এই টিভি চ্যানেলটির কর্তৃপক্ষই সমগ্র বাংলাদেশের প্রতিনিধি যেন!

অস্ট্রেলিয়ার কোন বিমানবন্দর থেকে যৌন হয়রানীর অপরাধে কোন বাংলাদেশীর গ্রেফতারের ঘটনা এটাই প্রথম নয়। এই বিশ্বকাপেই আরো একাধিক সাংবাদিক যৌন হয়রানির দায়ে গ্রেফতার হয়েছেন অথচ সেগুলি পত্র-পত্রিকায় আসে নি। এর আগে ২০১৪ সালের ২ এপ্রিল একই ধরণের একটি ঘটনা ঘটেছিলো। সেদিন সিডনি বিমানবন্দর থেকে ৩২ বছর বয়স্ক এক বাংলাদেশী ট্যুরিস্টকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তার বিরুদ্ধে ১৯ বছর বয়সী এক সুইস মেয়েকে অভিযোগ করেছিলো যে ২৯ মার্চ ২০১৪ সালে বাংলাদেশী ওই নাগরিক তাকে ডার্লিংহার্স্ট রোডের এক ব্যাকপ্যাকার্স হোস্টেলে থাকাকালীন আক্রমন করে এবং তার সাথে অশোভন ব্যাবহার করে। মেয়েটি পুলিশের কাছে অভিযোগ করার সময়ে বাংলাদেশী লোকটি ইতিমধ্যেই সেই হোস্টেল ছেড়ে পালিয়েছিল, তবে পুলিশ বিমানবন্দরগুলোতে তার নামে রেড অ্যালার্ট জারি করে। ২ এপ্রিল বিমানে চেপে বাংলাদেশে আসার সময় বিমান থেকে গ্রেফতার হন তিনি। এর আগে ২০০৬ সালে মেলবোর্নে কমনওয়েলথ গেমস কাভার করতে এসেও বাংলাদেশী সাংবাদিকেরা দেশের নাম উজ্জ্বল করেছিলেন এভাবেই।

ফ্রি সেক্স কাকে বলে, তার সংজ্ঞা দেওয়া আমার কর্ম নয়। তবে বাংলাদেশে যারা মেয়েদের অশালীন চলাফেরা দিয়ে ধর্ষণকে বা শ্লীলতাহানিকে জায়েজ করেন, অস্ট্রেলিয়াকে ইহুদী-নাসারাদের দেশ বলে বর্ণনা করেন, সেই সব মানুষেরাও এই দেশে এসে কি এক জাদুবলে সাধু হয়ে যান। রাস্তাঘাটে, বাজারে, কর্মস্থলে বা সৈকতে তারা নানারকম মানুষের সাথে মেশেন, কিন্তু কারো সাথে অশ্লীল আচরণ করেন না। কাউকে ধর্ষণে প্রবৃত্ত হন না। তারপরেও ধর্ষণ হয়তোবা ঘটছে তাদের বেডরুমে, বিবাহ নামক পর্দার আড়ালে, তবে ঘরের বাইরে তারা কি করে এমন মহাপুরুষ হয়ে যান? এই কারণটা উদ্ধার করতে পারলেই পেয়ে যাবেন অস্ট্রেলিয়ার কিম্বা যে কোন পশ্চিমা দেশের ফ্রি সেক্সের আসল রহস্য। যারা যারা সত্যি সত্যিই পশ্চিমা সমাজের ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং ফ্রিডম অফ চয়েস আত্নস্থ করতে পেরেছেন, তারা আমার নমস্য। আমাদের সিংহভাগের জন্য ব্যাপারটা সেরকম নয় বলেই জানি।