DSC_0223এতোদিন পশ্চিমে থেকেও আবহাওয়াটা ঠিক পোষায় না সাজিয়াদের। শীতকে প্রচণ্ড ভয় তার ওপর স্ক্যান্ডিনেভিয়ার কাছের এই দেশগুলোতে শীতের দিনে আলোও নেই, ঘুটঘুটে অন্ধকার। ক্রিসমাসের ছুটিতে প্রায়ই সূর্যালোকের খোঁজে এদিকে ওদিকে বেড়িয়ে পড়ে তারা। সারা জীবনের স্বপ্ন একবার ইজিপ্টে যাবে। সূর্যালোক খোঁজ করতে করতে ইজিপ্টে মন ঠিক করে আনন্দে আত্মহারা। যথাসময়ে বাক্স প্যাটরা গুছিয়ে চললো ইজিপ্ট-দ্যা ল্যান্ড অফ হিসট্রি।

লুক্সর টেম্পল, কোর্নাক টেম্পল, ভ্যালি অফ দ্যা কিংস, হাবু টেম্পল, টেম্পল অফ হাসিবস্যুট, কোম ওমবো ইত্যাদি নানা জায়গায় ভ্রমণ করলো নীলের ওপর দিয়ে, ক্রুজ ট্যুর ছিলো। আট দিনের ভ্রমণ শেষে দিগ্বিবিজয়ের আনন্দ নিয়ে তারা বাড়ি ফিরলো।

সাজিয়ার বারো বছর বয়সী মেয়েও বললো, মা, জীবনে যতো ছুটি কাটিয়েছি, ইজিপ্ট ইজ দ্যা বেস্ট।

আজকাল ফেসবুকের কল্যাণে কোন ইভেন্টই গোপন থাকে না, আর এটা গোপন থাকার তো কোন কারণই নেই। মহাসমারোহে ফেসবুকে ফটো পোস্ট করে চলেছে সাজিয়া। এতো এতো ছবি উঠিয়েছে ডিএসএলার-এ, বাছাই করে পোস্ট করাও একটা বিরাট কাজ। একদিন স্থানীয় একজন বেড়াতে এলেন। গল্প হচ্ছে, চা খাচ্ছে।

বললো, আপনাদের মিশরের ছবি দেখে খুবই ভাল লাগছে। কোথায় কোথায় গেলেন? আমারও অনেকদিনের ইচ্ছা ওখানে যাওয়ার, কতো ইতিহাস।

সাজিয়ার তো আনন্দে টইটুম্বর অবস্থা, আনন্দে আটখানা হয়ে ফেটে পড়ে বলতে লাগলো কোথায় কোথায় গিয়েছে।

উনি একটু অপেক্ষা করে বললেন, মুসা নবী যেখানে নীল নদকে ওনার লাঠি দিয়ে দুই দিকে দুই ভাগ করলেন, সেখানে যান নাই!

সাজিয়া একটু থমকে গেলো। তারপর বললো, এসবতো আসলে মিথ, লোকের মুখে মুখে ছড়ায়, এ ধরনের কোন জায়গার অস্তিত্ব আসলে নেই।

ভদ্রমহিলা খুবই রেগে গেলেন, কী বললেন? কী বললেন আপনি? মুখে মুখে ছড়ায়? কুরআনে লেখা আছে জানেন, আল্লাহর কুরআনে!

সাজিয়া নিরুত্তর। যেভাবে উনি রেগে গেছেন তাতে সে এখন কী বলবে বুঝতে পারছিলো না।

সাজিয়াকে এমনিতেই ভদ্রমহিলার কম পছন্দ। আল্লাহর প্রতি সাজিয়ার ডর ভয় কম, এমনিতে সাজিয়া মানুষ খারাপ না হলেও কোন ইসলামি রেওয়াজ পালন করে চলে না। ছেলেরা অল্পবয়সে অনেকসময় এমন হয় উনি দেখেছেন, আবার বয়স হলে ঠিকও হয়ে যায় কিন্তু মেয়ে এরকম উনি শুধু এই একটা চিজই দেখলেন। সাজিয়াকে নিরুত্তর করাতে পেরে উনি বিজয়ীর দম্ভে আবার বললেন, আমার পরিচিত অনেকেই যারা গেছেন তারা দেখে এসেছেন। অনেক মুসলমান ট্যুরিস্ট হিসেবে শুধু এটা দেখতেই যায়, এটা আসলে ইমানের ব্যাপার।

নিরুপায় সাজিয়া বললো, চলেন গুগুলে দেখি এমন কোন জায়গা মিশরে সত্যিই আছে কিনা?

তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে উনি বললেন, সব গুগলে থাকে না, সব গুগলের ব্যাপার না। অনেক কিছু কুরআনে আছে, ইমানের ব্যাপার।

রাগে লাল চেহারা করে বারবার যেই এমফেসিস তিনি ‘কুরআন’ শব্দের ওপর দিচ্ছিলেন সাজিয়া ভয়ে এতোটুকু হয়ে গেলো যে উনি না রাগে তাকে মার দিয়ে ফেলেন। সাজিয়া মিশরের ইতিহাস জেনে ও তাকে বলবে, কী না বলবে দ্বন্দ্বে পড়ে গেলো।

সবদিক বিবেচনা করে সাজিয়া তার মুখ বন্ধ রাখাই সমীচীন মনে করলো। এখন সে জেনে গেছে ধর্মানুভূতি আহত হলে মারাত্মক ক্ষেপে যাওয়ার, এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে মেরে-ফেলারও অধিকার আছে।

_________________________

[৩২০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে রাজা মেনেস উত্তর মিশর আর দক্ষিণ মিশরকে এক রাজ্যে পরিণত করেন। তার পর ৩১টি রাজবংশের শতশত রাজা-যাদের উপাধি ছিল ‘ফেরৌন’-এই মিশর রাজ্যটি শাসন করেন। কাজেই ‘ফেরৌন’- যাকে ‘ফেরাউন’ বলা হয়-তা কারো নাম নয়, এটা তৎকালীন মিশর শাসনকর্তার উপাধি। এই শতশত ফেরাউনদের মাঝে অনেকেই যেমন অত্যাচারী ছিলেন, আবার অনেকে দয়ালু প্রজাবৎসলও ছিলেন। আর এই ৩১টি রাজবংশের শতশত ফেরাউনদের মাঝে একজনই ফেরাউন আছেন যাঁর নামের আগে ‘দি গ্রেট’ কথাটি উল্লেখ করা আছে। আর তিনি হলেন ‘দি গ্রেট দ্বিতীয় রামেসিস’ যিনি ৬৭ বছর মিশরকে শাসন করেছেন। শুধু তাই নয়-তাঁকে তাঁর মৃত্যুর পরেও হাজার বছর ধরে মিশরবাসী ‘দি গ্রেট’ নামে ডেকেছে।

বনি ইস্রায়েলেরা প্রথমে মিশরের উদ্বাস্তু ছিল। অনেক বনি ইস্রায়েল দাস হয়ে মিশরে এসেছে এবং শত শত বছর সময়ের প্রবাহে স্থায়ীভাবেই বসবাস করছিল, আর তারা সিনাই উপদ্বীপের রামিশেজ প্রদেশে বসবাস করত। তাদের আদিবাস কেনান বা প্যালেস্টাইন। সেখান থেকে প্যালেস্টাইন বা কেনান দেশ পূর্বদিকে। মুসা বনি ইসরায়েলদের সাথে নিয়ে পূর্ব দিকে প্যালেস্টাইন না-গিয়ে সেখান থেকে পায়ে হেঁটে কয়েকশ মাইল পশ্চিমে নীল নদ পাড়ি দিতে যাবে কোন দুঃখে?

আর মুসা পালিয়েই বা যাবে কেন? মুসার নেতৃত্বে বনি ইস্রায়েলিদের যে-দলটি প্যালেস্টাইনে গিয়েছিল সে দলে সব মিলিয়ে প্রায় ছয় লক্ষ লোক ছিল, সাথে আরও ছিল তাদের বিশাল পশু পাল। ছয় লাখ লোক এক রাতে রাষ্ট্রীয় কোন আলাপ আলোচনা ছাড়া পালিয়ে দেশ ছেড়ে চলে যাওয়া কি সম্ভব? মুসার নিজের কিতাব ‘তোরা’ বা ‘তাওরাত’ থেকে একটি উদ্ধৃতি দিচ্ছি- “তখন রাত্রিকালে ফেরাউন মোসি (মুসা) ও হ্যারোনকে ডাকাইয়া বলিলেন, তোমরা উঠো, ইসরায়েলদিগকে লইয়া আমার প্রজাদের মধ্য হইতে বাহির হও, তোমাদের কথানুসারে মেষপাল ও গো-পাল সঙ্গে লইয়া চলিয়া যাও এবং আমাকেও আশীর্বাদ করো……” তার মানে, বেরুনোর কথা ফেরাউন নিজেই বলেন, মুসা পালিয়ে গেছে, এটা সত্যি নয়। এবং তিনি ঠিক হুমকি দিয়েও তাড়িয়ে দেন নি, মুসা তো তাঁর ঘরেই পালকপুত্রের মতো ছিলো।

‘দি গ্রেট দ্বিতীয় রামেসিস’ নীল নদে ডুবে মরেছেন একথা সত্যি। একটা দুর্ঘটনায় তিনি পানিতে পড়ে মারা যান কিন্তু সেটা হজরত মুসাকে মারতে গিয়ে, একথার কোন ঐতিহাসিক ভিত্তি আছে কি?]

__________________________________________________________________

এ সমস্ত খুব ভাল করে জানা থাকা সত্বেও সাজিয়া মুখ খুলে সামনের জনকে কিছুতেই বলতে পারলো না, যার অস্ত্বিত্ব নেই তাঁকে খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। গল্প গল্পই হয় আর বাস্তব বাস্তব। আসলে যখন কেউ কিছু মেনে নিয়ে তারপর কথা শুরু করেন তখন সেখানে আলোচনার আর কিছু থাকে না।