আমাদের পাড়ার শামসেদ উরফে কোপা শামসু আর জমসেদ উরফে মুছা জমসু বাল্যকালের বন্ধু। হরিহর আত্মা। কোপার ছায়া মুছা আর মুছার কায়া কোপা।

দুইজনে একই ক্লাসে পড়ে। প্রথম ঘটনা ঘটলো ক্লাস থ্রিতে পড়ার সময়। রতন ক্লাসে বিদেশি পেন্সিল বক্স নিয়ে এসেছিল। ওর বড় মামা জাপান থেকে পাঠিয়েছে। বাক্সের উপর নাচের ভঙ্গিমায় জাপানী কিশোরীর ছবি। চুম্বক লাগানো বাক্সের ঢাকনা খুললে ভেতর দেখে আরও মাথা খারাপ হয়ে যায়।শামসু রতনের বাক্স হাতে নিয়ে দেখতে চাইলো। রতন কাউকে হাত দিতে দিবে না। এক কথা দুই কথার পর শামসু বাক্স থেকে কাটা কম্পাস বের করে কোপের ভঙ্গিতে রতনের ঘাড়ে মারে। রতন বাবারে বলে চিৎকার দিয়ে বাক্স হাত থেকে ফেলে দেয়। রক্ত বের হয় বেশ খানিক ঘাড় থেকে। শামসু দৌড়ে পালায়।জমসু দৌড়ে রতনের কাছে আসে। জমসুর কোমরে একটা গামছা বাধা থাকতো সবসময়। সেই গামছা বের করে দ্রুত রতনের ঘাড়ের রক্ত মুছে ফেলে জমসু। কয়েক ফোঁটা রক্ত বেঞ্চে, মাটিতেও পড়েছিল। জমসু তার গামছা দিয়ে সেগুলোও মুছে ফেলে। হৈচৈ শুনে হেডমাস্টার এসে হাজির হয়। রতন গো গো করতে করতে বিচার দেয়, আমাকে মেরে রক্ত বের করে দিছে। ঐযে দেখেন স্যার বেঞ্চে রক্ত। হেডমাস্টার বেঞ্চে রক্ত খুঁজে পায়না। রতন ঘাড় দেখিয়ে আবার বলে, এই যে দেখেন স্যার ঘাড়ে রক্ত। হেডমাস্টার ঘাড়েও রক্ত খুঁজে পায় না। জমসু এবার সাক্ষী হয়ে এগিয়ে যায়। হেডমাস্টারকে বলে, এরকম একটা দামী পেন্সিল বক্স রতনের ক্লাসে আনা ঠিক হয়নাই। আর বাক্সের উপরে আজেবাজে ছবি। হেডমাস্টার রতনের পেন্সিল বক্স দেখে আচ্ছা করে রতনকে কান মলে দিয়ে বিদায় হয়। সেই থেকে শামসেদের নাম হয়ে যায় কোপা শামসু আর জমসেদের নাম হয়ে যায় গামছা জমসু , সংক্ষেপে মুছা জমসু।

ষোল বছর বয়সে কোপা শামসু, বারো বছরের আসমাকে কুপিয়ে ফেলে। আসমাকে আমরা পেয়েছিলাম পাট ক্ষেতের মধ্যে। আসমার শাড়ি দেখে চিনেছিল রতন। আসমা তখন ক্লাস সিক্সে পড়ত। শাড়ি পরার বয়স হয়নি। তারপরেও পরত। ঠিকভাবে পরতে পারতোনা। কোমরের কাছের অনেকটা বের হয়ে থাকতো। আচল সামলাতে পারত না। কিন্তু তারপরেও পরত। একটাই সবুজ রঙের শাড়ি ছিল আসমার। পাট ক্ষেতের কাদামাটির লেগে সেই সবুজ রঙ তেমন মলিন হয়নি। তার সাথে যোগ হয়েছে আসমার দুই পায়ের ফাঁক থেকে বের হওয়া রক্তের ধারা। মুছা জামসু দৌড়ে গিয়ে আসমার দুই পায়ের ফাঁক থেকে বের হওয়া রক্তের ধারা মুছে ফেলে। তারপর সবার দিকে তাকিয়ে বলে,
মনে হয় গরমে মাথা ঘুরে পরে গেছে।
রতন প্রতিবাদ করে বলে,
নাহ, আমার তো মনে হয় রেপ কেস।
মুছা জামসু গোঁয়ারের মতো বলে,
তুই জানলি ক্যামনে রেপ কেস? তুই দেখছস? এমনতো হইতে পারে পা পিছলায়ে পইড়া গেছে। চারদিকে যা কাদা।

জামসু মুছতে পারেনা ঠিকমতো। আস্তে আস্তে পুরো গ্রাম জেনে যায় এটা রেপ কেস। এটাও জেনে যায় এটা কোপা শামসুর কাজ। সালিশ বসে। জামসু বড়দের মধ্যেই বড় গলায় বলে,
– আসমা মেয়েটার যে সমস্যা ছিল এই ব্যাপারে কারো কোন সন্দেহ আছে?
সালিশের সবাই সম্মতি দিয়ে বলল, না নাই
জামসু বলে যায়,
– আসমার শাড়ি উঠে থাকতো গোড়ালির উপর। পায়ের পাতার পুরাটাই দেখা যেত। আসমার পেট দেখা যাইত। এমনকি মাঝে মাঝে নাভিও।

উপস্থিত মুরুব্বিদের চোখ আমুদে একটু বুদ হয়ে যায়। মনে মনে অনেকেই আসমার পেট নাভি দেখে নেয়। কেউ কেউ শিউরেও ওঠে একটু।

– সবচেয়ে ভয়ঙ্কর যেইটা আসমার আঁচল থাকতোনা ঠিকমতো। বুক দেখা যাইত।

বলতে বলতে কেঁদেই ফেলে মুছা জমসু । মুছা কেঁদে যায়, কাঁদতে কাঁদতে সব মুছে ফেলে। সালিশে সিদ্ধান্ত হয়,শামসুকে তার অপকর্মের জন্য মাফ চাইতে হবে। সেইসাথে আসমাকেও মাফ চাইতে হবে আর এখন থেকে সামলে চলতে হবে।

শামসু ঠোঁটে মৃদু হাসি নিয়ে বলে, সরি
আসমা চারিদিকে কি হচ্ছে বুঝতে পারেনা। কেউ একজন কানে কানে কবুল বলার মতো করে আসমাকে বলে দেয় কি বলতে হবে। আসমা যন্ত্রের মতো বলে,
– মাফ চাই। মাফ দেন।

কোপা শামসু প্রথম মার্ডারটা করে উনিশ বছর বয়েসে। রতনের ঘাড় বরাবর কোপ মেরে মাথাটা প্রায় আলাদা করে শরীর থেকে। রাতের বেলা সলিম ভাইয়ের চায়ের দোকানের সামনেই রতন পড়ে ছিল। মুছা জমসু খবর পেয়ে দৌড়ে হাজির হয়। চারিদিকে রক্তের বন্যা। মুছা জমসু তার গামছা দিয়ে রক্ত মুছে। দেখতে দেখতে রক্তের স্রোত অনেকটাই মুছে ফেলে। তারপর চারিদিকে তাকিয়ে বলে,
– মনে হয় রতন মাথা ঘুরে পড়ে গেছে। যা গরম পড়ছে।
কেউ একজন প্রতিবাদ করে,
– মাথা ঘুরে পড়লে ধড় থেকে মাথা আলাদা হয়ে যায় ক্যামনে?
মুছা জমসু হাল ছাড়ে না। বলে,
– তাইলে মনে হয় সলিম ভাই মারছে। হয়তো সলিম ভাই এর বাকি দেয় নাই।

আস্তে আস্তে খবর চাওর হয়ে যায়। রতনের সাথে ঠিক কি নিয়ে লেগেছিল কোপা শামসুর সেটা জানা যায় না। কেউ বলে রতন কোপাকে ধাক্কা দিয়েছিল, কেউ বলে রতন তর্ক করেছিল কোপার সাথে, কেউ বলে রতন কোপাকে কোপা বলে গাল দিয়েছিল। তবে কাজটা যে কোপাই করেছে সেটা অনেকটুকুই নিশ্চিত হওয়া যায়। এবারে আর সালিশে থেমে থাকেনা থানা পুলিশ হয় খানিক। মুছা পান চিবাতে চিবাতে গিয়ে পুলিশ স্টেশনে হাজির হয়ে জ্ঞান দেয়,
– এলাকার আইন শৃঙ্খলা কমে গেছে। শৃঙ্খলার অভাবেই আজকে রতন মরে গেছে। এত রাতে চায়ের দোকানে রতন কেন গেল? কি তার উদ্দেশ্য?

উদ্দেশ্য বিধেয় নিয়ে আরও কি কি সব জানি বলে যায় মুছা। একমাস পর ক্যালাতে ক্যালাতে জেল থেকে বের হয়ে আসে কোপা।

ছয়মাসের মধ্যে দ্বিতীয় কোপ দেয় কোপা। লোকজন জড় হয়ে একটু গুনগুন করার চেষ্টা করে। মুছা জমসু বিরক্ত হয়ে উপস্থিত জনগণকে বলে,
– আমি গত বিশ বছর ধরে কোপা শামসুর সাথে আছি। কখনো কোপা আমাকে কোপ দিছে? কোপারে না ঘাঁটাইলে কোপা কোপ দেয় না। তরা সবাই মিলে কোপারে লাড়াবি, আর কোপা একটু লড়লেই তার দোষ?

এভাবেই চলে। কোপা শামসু কোপায়, মুছা জমসু রক্ত মুছে।

মাসে অন্তত একটা কোপ না দিলে কোপা শামসুর ভাত হজম হয়না, রাতে ঘুম হয়না। ভয়ে সবাই কোপাকে এড়িয়ে চলে। কেউ কোপার সাথে কোন তর্কাতর্কিতে যায়না। কোপা যদি বলে বলে বাহান্ন, সবাই বলে বাহান্ন। কোপা যদি বলে তিপ্পান্ন, সবাই বলে তিপ্পান্ন। একদিন কে যেন ভুলে বলে ফেলেছিল যাহা বাহান্ন তাহা তিপ্পান্ন। সাথে সাথে কোপা কোপ বসায়। এরপর থেকে কেউ সেটাও করেনা। কোপা যা বলে এক কথায় মেনে নেয়। দিন যায়, মাস যায়, কোপা শামসু কোপানোর উছিলা খুঁজে পায়না।

কোপা মনমরা হয়ে বসে থাকে। একদিন মুছা জমসু হাসিমুখে এসে কোপার পেটে খোঁচা দিয়ে বলে, ক্যা রে কোপা, তর মনডা উদাস ক্যা রে? কোপা শামসু কোন কথা না বলে বিরক্ত মুখে মুছা জমসুরে চাপাতির কোপ বসিয়ে দেয়। একেবারে ঘাড় বরাবর। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটে। মুছা হতভম্ব হয়ে কোপার দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর হাতের গামছা দিয়ে রক্ত মুছার চেষ্টা করে। গামছা রক্তে ভিজে যায়, রক্ত থামে না।ঘাড় থেকে রক্তের ধারা নেমে মুছার কাঁধ পিঠ রক্তে ভিজে যায়। মুছা প্রাণপণে তার গামছা দিয়ে রক্ত মুছার চেষ্টা করে যায়। পারেনা। নিজের রক্ত মুছা সহজ না।