নন্দিনী

অনেকগুলো বছর একটা অক্ষরও লিখিনি । সব লেখালিখি বন্ধ করে দিয়েছি স্ব-ইচ্ছায়। এক সময় মনে হতে লাগল এ সব ফালতু লেখা লিখে কি হবে? কোন লাভটা হবে পৃথিবীর অথবা আমার নিজের…

দূরাগত কোন স্বপ্নের মধ্যেও ছিলনা এভাবে কোনদিন লিখতে হবে। না, লেখার জন্য কেউ আমাকে মাথার দিব্যি দেয়নি, কিন্তু গত তিন চার দিন ধরে ভিতরটা ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে, মনে হচ্ছে চিৎকার করে কাঁদি, প্রচণ্ড ক্ষোভ এবং ক্রোধে হাত পা নিসপিস করছে । কোথা থেকে শুরু করব কিছুই বুঝতেছি না, সব এলোমেলো লাগছে । যতই অগোছালো হোক অক্ষম হোক দু’লাইন না লিখে থাকতে পারছি না, তাই জং ধরা অনভ্যস্ত আঙুল দীর্ঘদিন পর কী-বোর্ডে রাখতে বাধ্য হয়েছি…

বৃহস্পতিবার আমাদের রাত দশটার দিকে সবে সুস্থির হয়ে বসে আইপ্যাড ওপেন করে প্রতিদিনকার মত নানা নিউজ সাইট গুলো ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে একটা হেডলাইনে চোখ আঁটকে যায়, অভিজিৎ রায় নেই ! তাঁকে কুপিয়ে হত্যা করেছে ওঁত পেতে থাকা বর্বর ঘাতকের দল, তাঁর জীবনসঙ্গী বন্যা কে প্রচন্ড আহত করে বীর দর্পে হেঁটে চলে গেছে, আর দেশের কিছু মানুষ একদিকে দাঁড়িয়ে তামাসা দেখায় ব্যস্ত, ছবি তোলায় ব্যস্ত… মনে হল এসব আমি স্বপ্নে দেখছি , এ সত্যি হতে পারে না কিছুতেই, কিছুতেই সত্যি হতে পারে না এ…

হেড লাইন আর একটা ছবি দেখার সাথে সাথে অদ্ভুত এক কান্ড করি আমি, আইপ্যাড টা ঠাস করে বন্ধ করে দেই । বন্ধ করে কাঁপতে থাকি । কয়েক মিনিট পর সম্বিত ফিরে এলে ভাবি, আমি যতই চোখ বন্ধ করে না না করি না কেন, তাতে কি প্রলয় বন্ধ থাকে ? ততক্ষণে অনেক নিউজ চলে এসেছে বিভিন্ন মাধ্যমে, পাগলের মত সব কিছু তন্ন তন্ন করে খোঁজে ফিরি বিস্তারিত জানার জন্য…

অভিজিৎ এর পরে থাকা নিথর দেহ আর রক্তাত্ত বন্যার অসহায় দাঁড়িয়ে থাকার ছবি দেখে মাথার ভিতর অসহ্য এক যন্ত্রণা হতে থাকে । রাত তিনটা অবধি চিৎকার করে কখনো কেঁদে, কখনো ক্রোধে ক্ষোভে বুক ভরা হাহাকার নিয়ে কখন যে এক সময় ঘুমিয়ে পরি নিজেই জানি না…

একসময় ক্ষুদ্র একজন লেখক হিসেবে মুক্তমনার সাথে আত্মিকভাবে জড়িত ছিলাম অনেকগুলো বছর ।

অনেক লেখাই মুক্তমনার প্রথম দিকে লিখেছি । সে সুবাদে অভিজিৎ এর সাথে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল, বিভিন্ন লেখা নিয়ে আলোচনা সমালোচনা হত । তাঁর থেকে লেখালেখির জন্য যে উৎসাহ উদ্দীপনা পেতাম তা ভুলার নয় কিছুতেই । আমার নিজের সাইট করার সময় ও অনেক সহযোগিতা পেয়েছিলাম তাঁর কাছ থেকে । কত কথা কত স্মৃতি একে একে সব কিছু মনে পরতে থাকে, অথচ আমরা কেউ কাউকে সামনা সামনি দেখিনি কখনো । সব সময় সামনা সামনি দেখা হওয়াটা যে জরুরি নয়, এত গুলো বছর যোগাযোগ না থাকার পর ও তা তীব্রভাবে আন্দোলিত করছে আমাকে…

অভিজিৎ কি ছিলেন, তাঁর প্রতিভা কোন পর্যায়ের ছিল তা এই ঘাতকেরা বুঝবে না কখনও, এদের বোঝার মত সে মগজ ও নেই । অভিজিৎ এর লেখা বুঝতে হলে, মগজে ধারণ করতে হলে এদের আরো শত বছর সাধনা করতে হবে, মনুষত্যের সাধনা…

এই মুহুর্ত্যে আমাদের একটাই চাওয়া বিনা বিচারে যেন পার পেয়ে না যায় এইসব ঘাতকেরা । এদের আস্ফালন কঠোর হস্তে এখনই থামাতে না পারলে সামনে এই দেশের ভয়ানক দুর্দিন অপেক্ষা করছে এ বিষয়ে কোনই সন্দেহ নেই…

অভিজিৎ রা প্রতিদিন জন্মায় না, প্রতি ঘরে ঘরেও জন্মায় না । আমরা হুমায়ূন আজাদকে হারিয়েছি, অভিজিৎ কে হারালাম, আমরা আর কোন অভিজিৎ কে হারাতে চাই না…

বন্যা ভাল হয়ে উঠুক । পৃথিবীর সকল অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে সে আর তাদের মেয়ে মাথা তুলে দাঁড়াক, বীর দর্পে এগিয়ে যাক, এই কামনা…