কাউকে তার মতামতের জন্য অগ্নিদগ্ধ করা মানে ঐ মতামতের উচ্চ মূল্য নির্ধারণ করা। (মিশেল মঁতেইন, ১৫৭২)

১৭৯৪ সনের কথা। প্যারিসের কারাগারে বসে একটি বই লিখতে শুরু করেন আঠারো শতকের বিশিষ্ট ইংরেজ লেখক টমাস পেইন। মাত্র বছর তিনেক আগেই তার লেখা ‘রাইটস্‌ অব ম্যান’ রাজতন্ত্রের ভিত এতটাই নাড়িয়ে দিচ্ছিল যে, তাকে আর ইংল্যান্ডে সহ্যই করা হল না। তো সেই পেইন প্যারিসের কারাগারে বসে ‘এজ অব রিজন’ নামে যে বইটি লিখলেন, তা খ্রিস্টধর্ম ও বাইবেলকে প্রায় উলঙ্গ করে ছাড়ার জন্য ইতিহাস হয়ে থাকল! বলা বাহুল্য, ‘সোসাইটি ফর দ্য সাপ্রেশন অব ভাইস’ নামক একটি সংস্থার করা মামলায় ১৭৯৭ সালে শুধু বইটি নিষিদ্ধ করাই হল না, প্রকাশককেও এক বছরের কারাদণ্ড দেয়া হল। এরপর ১৮১১ সনে যখন বইটির ৩য় খন্ড প্রকাশিত হয়, তখন আবারো প্রকাশককে আঠারো মাসের কারাবাস এবং শাস্তি-স্তম্ভে দাঁড়ানোর রায় জারি হয়। আশ্চর্যের বিষয় হল, বিচারক লর্ড এলেনবরো স্বয়ং ছিলেন পক্ষপাতদুষ্ট, তার অভিমত ছিল: “যে গ্রন্থ আমাদের ধর্মবিশ্বাসের ভিত্তিস্বরূপ, তার সত্যতা অস্বীকার করার অনুমতি কখনো দেওয়া হয়নি।” এলেনবরোর এইরকম অযৌক্তিক ভাবনায় ক্ষুদ্ধ হয়ে কবি শেলি যে পত্রখানা লিখেছিলেন, তাও ইতিহাস হয়ে আছে:

আপনি কি মনে করেন মি. ইটনের অস্তিত্বকে বিষিয়ে তুলে আপনি তাঁকে আপনার ধর্মে ধর্মান্তরিত করতে পারবেন? আপনি উৎপীড়ন দ্বারা তাঁকে বাধ্য করতে পারেন আপনার মত প্রকাশ্যে সমর্থন করতে, কিন্তু তিনি সেগুলি বিশ্বাস করতে পারবেন না, যদি না আপনি সেগুলিকে বিশ্বাসযোগ্য করেন, যা সম্ভবত আপনার ক্ষমতার বাইরে। আপনি কি মনে করেন যে আপনার অতি উৎসাহের এই প্রদর্শন দ্বারা আপনি আপনার পূজিত ঈশ্বরকে খুশী করবেন? যদি তাই হয়, তাহলে অনেক জাতি যে দানবের উদ্দেশ্যে নরবলি দেয়, সে দানব সভ্য সমাজের ঈশ্বর অপেক্ষা কম বর্বর।

ঈশ্বরকে খুশী করতে মানুষের এই বর্বরতা আদিম যুগ থেকে এখনো বহমান, প্রাচীন গ্রিক রাজা আগামেনন দেবতাদের খুশী করতে তার কন্যা ইফিজিনিয়াকে বলি দিয়েছিলেন, আবার যেহেতু পরিষ্কার ঐশী-বানি ছিল: ‘তোমরা কোন ডাইনির জীবিত থাকা বরদাশত করবে না’, সেহেতু ডাইনি পোড়ানো মহোৎসব চলেছিল মধ্যযুগে, আর এ যুগে চলছে জবাই; কসাই যেমন নিখুঁত হাতে চারপেয় জীবের হাড্ডি-মাংস-মস্তক ছিন্ন-ভিন্ন করে, তেমনি নিখুঁত হাতেই চলে এখন দুপেয় জীবের ব্যবচ্ছেদ! যে দুপেয় জীবগুলো বনের পশু-পাখীর মত কর মুক্ত ছুটতে চায়, বিশেষত, তাদেরই হতে হয় প্রাথমিক ও প্রধান শিকার; এদের অপরাধ, এরা অনুশাসনের জোয়াল মানতে চায় না। কোন কোন দুপেয় থাকে, শুধু নিজের জোয়ালটাই তুলে ফেলেই সন্তুষ্ট থাকে না, পুরো সমাজের জোয়াল ভাঙ্গার করে ধনুকভাঙ্গা পণ, চালিয়ে যায় স্রোতের প্রতিকূলে এক অসম যুদ্ধ!

অভিজিৎদা সেই যুদ্ধে বলী হতে পারেন, তা অনেকেই জানত, নিজেও জানতেন, কিন্তু তবু থামেননি। যদি থামবেনই, তাহলে তো কষ্ট করে এই যুদ্ধ ডেকে আনার দরকারই ছিল না; আমেরিকার ঝা চকচকে সুরম্য প্রসাদে বসেও দুচোখে তার দূরাগত এক সমাজের হাতছানি, একটি মুক্তমনা সমাজ, মুক্তমনা বাংলাদেশ, যে দেশে কেউ শুধু একটি ধর্মে বিশ্বাসের জন্য নির্যাতিত হবে না, একটি বিশেষ বর্ণে-গোত্রে-লিঙ্গে জন্ম নেয়ার জন্য নিপীড়িত হবে না, যেখানে থাকবে সমকামী-বৃহন্নলা-প্রতিবন্ধী সবার সমান অধিকার, যেখানে শুধুমাত্র মত প্রকাশের জন্য কারো উপর নেমে আসবে না হুলিয়া! যেখানে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করে কেউ ‘ভি’ চিহ্ন দেখাবে না। যেখানে সবাই যুক্তির উপর নির্ভর করবে, সংস্কারের উপর নয়। যেখানে জ্ঞান-বিজ্ঞানের সবগুলো দরজা থাকবে খোলা, অনুসন্ধিৎসু তরুণেরা নিবিড় গবেষণায় রত থাকবে দিবানিশি। তেমন একটা সমাজ। তেমন একটা মুক্তমনা দেশ। অভিজিৎদা যে দেশে জন্মেছেন, সেই দেশটি এমন কি হবে না? মানুষকে বোঝালে, বুঝবে না?

সেই অভিজিৎদাকে প্রথম আবিষ্কার করেছিলাম ‘আলো হাতে চলিয়াছে আধারের যাত্রী’তে। তার লেখাগুলির মধ্যে কি যেন থাকত, সেই দিনগুলিতে আমি তাকে নিয়েই পড়ে থাকতাম, রাত নেই, দিন নেই, পাগলের মত পড়ছি তার লেখা, তার ব্লগ, তার বই! এত মাদকতা যাকে নিয়ে, সেই লেখক অভিজিৎ রায়কে হয়ত পুজোই করেছি, কিন্তু ভালবেসেছি কিন্তু মানুষ অভিজিৎদাকেই, পরে যখন চিনেছি-জেনেছি।

এত পড়াশুনো, এত পরিচিতি, অথচ কি বিনয়, কি ভালবাসা, কি সাহস, কি অবিচলতা! অভিজিৎদা অবিশ্বাসী ছিলেন, কিন্তু কোন বিশ্বাসী কি জানে, একজন বিশ্বাসীর প্রতি তার ভালবাসা যেকোন অবিশ্বাসীর চেয়েও বেশী ছিল? এতই ভাল লেগেছিল মানুষটাকে যে, আমার একটি আইডির পাসওয়ার্ডে বসিয়ে দিয়েছিলাম তার নাম। সেই সময় পাসওয়ার্ড এক্সপায়ার করাতে আমি একজন প্রিয় মানুষের নাম খুঁজছিলাম, অভিজিৎদা ছাড়া আর কারো নাম মাথায় আসেনি তখন।

অভিজিৎদা অবিশ্বাসের দর্শন নিয়ে লেখালেখি করেছেন বটে, কিন্তু কখনই বিশ্বাসীদের আঘাত করে কিছু লেখেননি। তবে তিনি সোচ্চার ছিলেন অনুভূতির সর্বগ্রাসী দানবীয় চেহারা নিয়ে, যা নিয়ে স্যার জেমস এফ স্টিফেন ঊন-বিংশ শতাব্দীতে লিখেছিলেন:

আইন যদি সত্যিই নিরপেক্ষ হত এবং বিশ্বাসীদের অনুভূতিতে আঘাত করে বলে শুধু ধর্ম-নিন্দার জন্য শাস্তি দিত, তাহলে তার উচিত ছিল অবিশ্বাসীদের অনুভূতিকে আঘাত করে এমন প্রচারণাকেও শাস্তি দেওয়া।

স্পষ্টতই বিচারকেরা একটি সূত্র অনুসরণ করতেন, তা হল, খ্রিস্টধর্মের মূল নীতিগুলির সত্যতা অস্বীকার করা একটি অপরাধ, যখন তারা এমনটি করতেন, তখন তারা বিস্মৃত হতেন যে, বাইবেল আইনের অংশ নয়।

অভিজিৎদা চলে যাওয়ার পর যখন পৃথিবীটা অন্ধকার হয়ে এসেছিল, তখন মনে হয়েছিল, এইসব লেখালেখি, মুক্ত পাঠ, সব ছেঁড়েছুঁড়ে দেব, যখন শেষ আলোটুকুও নিভে যেতে বসেছিল, তখনই মনে হল, নাহ্‌, কিছু হারায়নি তো! অভিজিৎদা তো চলে যায়নি, তিনি আছেন আমার পাসওয়ার্ডে, তাকে দিয়েই তো আমি প্রবেশ করি মুক্ত উদ্যানে, প্রাণ ভরে শ্বাস নেই উন্মুক্ত প্রান্তরে, মনের আনন্দে ঘুরে বেড়াই নক্ষত্রভরা মুক্ত আকাশের নীচে, মুক্ত ঘাসে ঘাসে, মুক্ত জলে, মুক্ত হাওয়ায়! অভিজিৎদা সবসময় সঙ্গে আছেন আমার সাথেই, কারণ তিনিই তো আমার পাসওয়ার্ড!

‘তোমরা যাও। ধুধু
শূন্য ওই মাঠে গিয়ে আবার দাঁড়াও। কিন্তু শুধু
নির্বিকার দাঁড়িয়ে থেকো না।
হাতে হাত রাখো, চক্ষু দু’হাতে ঢেকো না।
কাজ বাকি পড়ে আছে, তাই
এখন সবাই/
আবার সাজাও মঞ্চ তা হলে, টাঙাও সামিয়ানা।’ (এবার মৃত্যুকে মারো, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী)