আমার বান্ধবী সুজানের সঙ্গে আমার প্রায়ই দেখা হয় – রাস্তায়, পার্কে, দোকানে, বাচ্চাদের স্কুলে। সব সময়ই সে বেশ হাসিখুশি ও উৎফুল্ল থাকে। একদিন তাকে তার বাড়ির সামনে দেখলাম – বাচ্চাদেরকে স্কুলে যাবার জন্য বিদায় জানাচ্ছে। স্কুল নিয়ে যাচ্ছে তার বর নিক। যথারীতি সুজানের মুখে ছিল অমলিন হাসি। আমাকে হাসিমুখে সুপ্রভাত জানালো, কুশল-বিনিময় হলো ওর সঙ্গে আমার অন্যান্য দিনের মতন। বাচ্চাদের আদর করে স্কুলের জন্য বিদায় জানিয়ে দিলো। কিন্তু তাকে সেদিন দেখে আমি একটু চমকে উঠলাম। কারণ, তার মাথাটি ন্যাড়া। তার মাথার সোনালি কোঁকড়ানো চুলগুলি সে শেভ করে ফেলেছে। কী অদ্ভুত ব্যাপার! একবার ভাবলাম, ওকে জিগ্যেস করি, তোমার চুল কোথায়? আবার সংযত হয়ে ভাবলাম, কী দরকার জিগ্যেস করার, হয়ত মাইন্ড করবে। আমি এদেশে বেশ কয়েকজন তরুণীকে দেখেছি মাথা ন্যাড়া করে নিঃসংকোচে লোকালয়ে হাসিমুখে ঘুরে বেড়াতে। অনেক পুরুষ তো মাথা নিয়মিত শেভ করে রাখে এখানে। আজব ব্যাপার। ছোটবেলায় যখন আমার মাথা ন্যাড়া করে দেওয়া হতো লজ্জায় সংকোচে আমি কুঁকড়ে থাকতাম। নিজের চুলহীন মাথাটা কারুর সামনে বের করতে ইচ্ছা করতো না। আয়নায় নিজের ন্যাড়া ও কু-আকৃতির মাথা দেখে নিজেই লজ্জা পেয়ে মুখ গোমড়া করে ফেলতাম। এরা দেখছি অন্য রকম। কখনো চুলের পেছনে হাজার ডলার খরচ করে, আর কখনো চুলের বংশসহ মাথা থেকে উৎখাত করে দেয়।

তার কয়েকদিন পরের কথা। আমি পার্কে বসে আছি। সুজানের মা এসে বসলো আমার পাশে। কুশল বিনিময়ের পর টুকটাক কথা হচ্ছিল ওর সাথে। ভদ্রমহিলার আশি বছরের উপরে বয়েস। দেখতে এখনো বিষম সুন্দরী। কথাবার্তা চালচলন খুব চমৎকার। এখনো শারীরিকভাবে সুস্থ সবল সমর্থ। এই বয়েসেও একঘণ্টা ড্রাইভ করে প্রায় প্রতিদিনই দেখতে আসে কন্যা জামাতা ও নাতনীদেরকে। কখনো কখনো রাতে থেকেও যায় কন্যার বাসায়। আমি তাকে জিগ্যেস করলাম, প্রতিদিন এতদূর থেকে ড্রাইভ করে আসা ত তোমার জন্য কষ্টকর। আজ রাতে কি থাকছ, নাকি চলে যাচ্ছ? সে চোখ ছলছল করে বললো, আজ থেকেই যাচ্ছি। কারণ বেবীদেরকে কাল স্কুলে আমিই নিয়ে যাবো। আমার সুজি অসুস্থ হবার পর থেকে আমিই বেশিরভাগ সময় ওদের স্কুলে আনা-নেওয়া করি। আমার সুজি ও নিকের অনেক কষ্ট হয় যে নইলে। ওদের দু’জনেরই চাকরি আছে, তার উপর সুজিকে নিক ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায় প্রায়ই। আমি বাচ্চাদেরকে দেখাশোনা করি, ওদের সঙ্গ দেই। আমি বললাম, সুজানে অসুখ নাকি? আমি জানতাম না। কি অসুখ?
সুজানের মা বলতে শুরু করলো;
আমার সুজি বেবীর স্তন ক্যান্সার ধরা পড়েছে। ক্যামো চলেছে বেশ অনেকদিন ধরে। আক্রান্ত স্তনটি সার্জারি করে কেটে বাদ দেওয়া হয়েছে। ক্যামোর ফলে ওর চুল সব পড়ে গিয়েছিল। তুমি দেখনি?

আমার মনটা অসম্ভব ভারাক্রান্ত হয়ে গেল সুজানের মায়ের কথা শুনে। সুজান এতদিন ধরে এমন কঠিন রোগে আক্রান্ত, অথচ আমি জানতামই না! আমার সঙ্গে ওর প্রায়ই দেখা হয়, কথা হয়। আমাকে নিজের অসুখের কথা বলেনি ও কোনোদিন। এমন কঠিন একটা অসুখ নিয়ে, মরণব্যাধী নিয়ে কী সুন্দর হাসিখুশি থাকছে ও! চাকরি সংসার বাচ্চাকাচ্চা সবই ঠিক রেখেছে। মুখে অসুখের কোনো ছায়া নেই। আমি বললাম, আমি সুজানের অসুখের কথা শুনে খুবই দুঃখিত। সুজানে মা বলে চললো;
তুমি খেয়াল করেছ কি, আমার সুজির মাথায় ছোট্ট ছোট্ট চুল গজিয়েছে। মনে হচ্ছে, ও বয় কাট দিয়েছে চুলে। ওকে খুব কিউট লাগছে না এইরকম চুলে? আমি বললাম, হ্যাঁ, সুজানকে খুবই কিউট লাগছে। ও বললো, আমার সুজি বেবী, আমার প্রিন্সেস এমনিতেই খুব কিউট, খুব সুইট, তাই না? আমি বললাম, হ্যাঁ, সুজান অবশ্যই খুব কিউট, খুব সুইটহার্ট।

সুজানের মা বলছে, জানো, সুজি ছোটবেলা থেকেই এতো স্বাস্থ্য-সচেতন, নিয়মিত ব্যায়াম করে, স্বাস্থ্যকর খাবার খায় সব সময়, তবুও কেন যে ওর এমন একটা অসুখ হলো। আমাদের ফ্যামিলি হিস্ট্রিতেও কোনো ক্যান্সার নেই।

ক্যান্সারের কথা শুনলেই আমার ভয় লাগে। আমি কী বলবো বুঝতে পারছিলাম না। শুধু শুনে যাচ্ছিলাম ওর কথা। ও বলে যাচ্ছিলো-
জানো, আমার জামাতা নিক অসম্ভব ভালো মানুষ। সুজির এই সময়ে ও বিশেষভাবে দেখাশোনা করে, যত্ন করে ওর। কাজ থেকে ফিরে বাচ্চাদের দেখে, ঘরের কাজ করে, সুজিকে দেখে, ওকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। এইতো ক’দিন আগে ওরা দু’জনে জ্যামাইকা থেকে ঘুরে এলো। বাচ্চাদেরকে আমি আমার কাছে রেখে দিয়েছিলাম, যাতে ওরা একান্তে সময় কাটাতে পারে।

তার কয়েকদিন পর স্কুলে ড্যান্স ফ্যাস্টিভেল হলো। তাতে ছোটদের নাচ শুরু হবার আগে বড়রা নেচেছে। সুজানও নেচেছিল। কী প্রাণবন্ত সুন্দর নাচ তার! চোখেমুখে আনন্দ উচ্ছ্বাস জ্বলজ্বল করছিল। অসুখের কোনো চিহ্ন ছিল না তার মুখে কিংবা ব্যবহারে।

সুজান ও নিকের সাথে আমার আগের মতই নিয়মিত দেখা হয়। সব সময় হাসিমুখ ওদের। কী চমৎকার সম্পর্ক ওদের দু’জনার মধ্যে! আমি সুজানকে তার অসুখের কথা কিছু জিগ্যেস করবো করবো ক’রেও করতে পারি না দেখা হলে। ভয় লাগে আমার। আমার মন ভারাক্রান্ত হয়ে যায় ওকে দেখলেই।

গরমকালে গরমের পোশাক পরে সুজান। ক্যান্সারের কারণে তার একটা স্তন কেটে বাদ দিতে হয়েছে। সংক্ষিপ্ত পোশাক পরলে স্পষ্টতই তা চোখে পড়ে। কিন্তু সুজানের তা নিয়ে কোনো সংকোচ নেই, কোনো জড়তা নেই, কোনো রাখঢাক নেই, কোনো হা-হুতাশ নেই। কোনোভাবেই সে তা ঢেকে রাখার চেষ্টা করে না।

একবার আমরা বেশ কয়েকজন বন্ধু মিলে বীচে গিয়েছিলাম। সুজান আর নিকও গিয়েছিল। আমি সুজানের কাছে গিয়ে বসলাম একসময়। ওকে জিগ্যেস করলাম, বর্তমানে ওর শরীর কেমন আছে ইত্যাদি। ও বলে চললো একে একে সব। কীভাবে অসুখটা ধরা পড়লো, কীভাবে চিকিৎসা হলো, ক্যামো নিলো কীভাবে, তার চুলগুলি ঝরে গিয়ে আবার গজানোর গল্প, সার্জারির গল্প, আরো অনেক অনেক কথা। ওর গলা ও বগলের নীচে বড় বড় গোটার মত কিছু বৃদ্ধি পাচ্ছিল; হয়ত চিকিৎসার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে। ওর পরনে সাঁতারের পোশাক ছিল, তাই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। আমার ভয় লাগছিল ওর গল্প শুনে, ওকে দেখে, খারাপ লাগছিল ওর জন্য। কিন্ত ও নিজে একেবারে সাবলীল, মুখে অম্লান হাসি। হেসে হেসেই অবলীলাক্রমে সব কথা বলছে। ও বলছিল, চিকিৎসা চলছে এখনো। আরো অনেকদিন চলবে। ক্যামোর ফলে ওর ফুসফুস আক্রান্ত হয়ে পড়েছে। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয় ওর। রাতের বেলায় ভীষণ শ্বাসকষ্ট হয়। ফুসফুসে একটা অপারেশন করতে হবে।

সুজান বলছিল, সে স্তন ইমপ্ল্যান্ট করানোর কথা ভাবছিল। ডাক্তারের সাথে কথা বলেছিল এই ব্যাপারে। আবার বললো, অনেক খরচান্ত। তাছাড়া কৃত্রিম স্তনের দরকারই বা কি? নিক সুজানের পাশে বসে ছিল। ও সুজানের হাত চেপে ধরে বললো, সত্যিই, ওটা মোটেই জরুরী নয়, হানি। আমার কাছে ত নয়ই। কথা বলতে বলতে সন্ধ্যা হয়ে এলো। সুজান আর নিক বললো, আজকের দিনটা কেমন সুন্দর না? আমি বললাম, হ্যাঁ। ওরা বললো, আজ অনেক রাত পর্যন্ত আমরা এখানে থাকবো। ওরা পরস্পরকে জড়িয়ে ধরলো। আমি বললাম, অনেক চমৎকার সময় কাটুক তোমাদের। আমি উঠে এলাম ওদের কাছ থেকে।

গ্রীষ্মের ছুটি চলছিল। ওদের সাথে দেখা হলো একদিন ওদের বাড়ির সামনে। আমি জিগ্যেস করলাম, গরমের ছুটি কেমন কাটাচ্ছ? ওরা বললো, খুব ভালো। এইতো কালই আমরা হাওয়াই দ্বীপ থেকে ফিরলাম। দুই সপ্তাহ ছিলাম। অনেক খরচান্ত ভ্রমণ ছিল এটা। কিন্তু আমাদের পয়সা উসুলের উপর গিয়ে গেছে। অত্যন্ত ভালো লেগেছে। সামনের সপ্তাহে একটা লেক হাউসে যাচ্ছি কয়েকদিনের জন্য।

আমি ওদেরকে দেখে দেখে, ওদের সাথে কথা বলে বলে শুধু অবাক হই। কী অদ্ভুত সুন্দর ওদের মন! সুজনের বয়েস ৪৫ বছরের মত। এখনো সে তার মায়ের কাছে কিউটি বেবী, সুইটি প্রিন্সেস। ক্যামোতে যখন সুজানের সমস্ত চুল পড়ে গিয়েছিল তখন কোনোদিন সে পরচুলা পরেনি। সম্পূর্ণ চুলহীন মাথায় ও কাজে গেছে, সবখানে গেছে। কৃত্রিম চুল দিয়ে ওর চুলহীন মাথাটা ঢাকার চেষ্টা করেনি। সংকোচও বোধ করেনি কোনো। তার একটা স্তন কেটে বাদ দিতে হয়েছে। এজন্যও সে কোনোদিন কোনো রাখঢাক করেনি। কোনো কৃত্রিমতা দিয়ে ঢাকেনি বাস্তবতাকে। একজন নারীর একটা বিশেষ অঙ্গ কেটে ওর শরীর থেকে বাদ দিতে হয়েছে। এজন্য ওর বর নিকের মুখে আমি কোনোদিন বিবর্ণতা, বিমর্ষতা দেখিনি। শুনিনি কোনোদিন তাকে হা-হুতাশ করতে। ওদের প্রেমময় সম্পর্কের একটু অবনতি ঘটেনি। ভাঁটা পড়েনি ওদের জীবন উদযাপনে। এজন্য সুজানের প্রতি নিকের ভালোবাসা, টান একটু কমে যায়নি। সবসময়ই নিক সুজানের কাছে আছে, হাত ধরে আছে, অন্তর দিয়ে আছে- হাসিমুখে, প্রেমময় প্রেমিক হিসেবে, নির্ভরযোগ্য বর হিসেবে, সমব্যথী বন্ধু হিসেবে, সহমর্মী সঙ্গী হিসেবে, সহযোগী জীবনসঙ্গী হিসেবে। প্রতি মুহূর্তেই ওরা জীবনকে উদযাপন করছে মুখে অমলিন হাসি নিয়ে, বুকে ভালোবাসা নিয়ে। ওদের এভাবে দেখলে আনন্দে আমার মনটা ভরে যায়। ওদের আনন্দের কিছুটা ভাগ আমিও পাই। কী অদ্ভুত সুন্দর ওদের মন! কী অদ্ভুত সুন্দর ওদের মনোবল! কী অদ্ভুত সুন্দর পরস্পরের প্রতি ওদের ভালোবাসা! সেল্যুট সুজান, সেল্যুট নিক। এভাবেই হেসেখেলে সব অবস্থায় জীবনকে উদযাপন করে যাও সব সময়।