মানুষই,সম্ভবত,সবচেয়ে উন্নত ও সুষ্ঠু ভাষাবোধ সম্পন্ন প্রাণী। সুতরাং এটা ধরে নেয়া যায় যে ভাষাবোধ মানুষের সহজাত বৈশিষ্ট্য। ফলে মানুষ ভাষা নিয়ে বেশ কৌতূহলী হয়ে উঠেছিল সেই প্রাচীন ও প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই। শুধু মানুষই নয়;-পৌরাণিক ঈশ্বরও মাথা ঘামিয়েছেন ভাষা নিয়ে এবং ভাষা হয়ে উঠেছে মানুষ ও ঈশ্বরের একচ্ছত্র হাতিয়ার। প্রাচীন ধর্মগ্রন্থগুলো প্রায়ই সাক্ষ্য দেয় মানুষ ও ঈশ্বরের ভাষাবোধের যেখানে ঈশ্বর নামে কোন এক তথাকথিত অতিন্দ্রীয় স্বত্ত্বা ভাষার উপর প্রচন্ড নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল এবং নির্দিষ্ট এক বা একাধিক ভাষিক ধ্বনির সহায়তায় আদেশ করেছিল(কাকে আদেশ করেছিল জানা যায় না যদিও)যেন সৃষ্টি হয় সবকিছু। কোন কোন ঈশ্বর আরো অগ্রসর হয়ে মানবজাতির প্রতি ছুড়ে দিয়েছিল অযৌক্তিক চ্যালেঞ্জ। নিজ উদ্যোগে আহবান করেছিল ভাষা-প্রতিযোগীতার। প্রতিপক্ষকে বলা হল তার প্রেরিত গ্রন্থের মত বা তার চেয়ে উন্নত কোন ভাষিক গ্রন্থ তৈরী করে আনতে; যদিও ঐ সমস্ত পারলৌকিক গ্রন্থগুলো সেই সময়ের জন্যও ছিল খুব নিকৃষ্ট। ভাষাবোধ নিয়ে ঈশ্বরের চেয়ে কম মাথাব্যাথা ছিল না তার অনুসারীদের এবং এ অনুসারীদের কেউ কেউ মানব জাতির জন্য এত গুরূত্বপূর্ণ যে তার কানাকড়ি গুরূত্বও বহন করে না তাদের সৃষ্টিকর্তারা। এ রকমই একজন অনুসারী হলেন দার্শনিক পাণিনি।খ্রিপূ নয় শতক মতান্তরে খ্রিপূ চার শতকে জন্ম গ্রহণ করা পাণিনি ছিলেন শিবভক্ত দার্শনিক ও ব্যাকরণবিদ। বলা হয় দেবতা শিব নৃত্যের ভংগীতে ঢাক বাজাতে বাজাতে চৌদ্দটি নতুন শব্দ তৈরী করেছিলেন আর শিবভক্ত পাণিনি সেগুলো সূত্র হিসেবে গ্রহণ করেছেন প্রায় চার হাজার শ্লোক সম্বলিত তাঁর বিখ্যাত ‘অষ্টাধ্যায়ী’ নামক ব্যাকরণ গ্রন্থে। কেন প্রয়োজন পড়ল এ গ্রন্থ রচনার? যতটুকু জানা যায় পাণিনির সময়কালে বৈদিক সংস্কৃত হারাচ্ছিল তার সিংহাসন। নানা রকম ভাষ্য তৈরী হচ্ছিল লোকমুখে। ফলে শিব ভক্ত দার্শনিক পাণিনি প্রয়োজন বোধ করেছিলেন এমন কোন সূত্র রচনার যার মধ্য দিয়ে বেঁচে যাবে বেদের কুমারীত্ব। ‘অষ্টাধ্যায়ী’কে ভাষাতত্ত্ববিদেরা মনে রাখেন এবং,সম্ভবত,রাখবেন এটির অসাধারণ ও অভিনব অন্তর্দৃষ্টির কারণে। পাণিনির ব্যাকরণ বর্ণনাত্নক;-ফলে বেশ অন্তদৃষ্টির ছোঁয়া পাওয়া যায় এ ব্যাকরণে। কিন্তু চেলাদের দৌরাত্ন্য থামে না কোনদিন। এ ব্যাকরণকে পরবর্তীতে অমেধাবী অনুকরণকারীরা পরিণত করেছিল বেদের মতই কোন প্রত্যাদেশে এবং এটিকে বিবেচনা করা হতে থাকে আনুশাসনিক ব্যাকরণের আকর গ্রন্থরূপে। আমাদের বাংলা ভাষার ব্যাকরণ অনেকাংশেই পাণিনির ব্যাকরণবোধ দ্বারা আচ্ছন্ন; যদিও পরবর্তিতে অনেক মিশ্রণ ঘটেছে এখানে। পাণিনির আগেও পাওয়া যায় ব্যাকরণ রচনার বেশ কিছু নিদর্শন। যেমন দার্শনিক যাস্ককে(খ্রিপূ আনু ৮০০)ধরতে পারি। তিনি ব্যস্ত ছিলেন শব্দের ব্যুৎপত্তি নির্ণয়ে। কেননা তখন প্রাচীন ভারতের দার্শনিক সম্প্রদায় নিজেদের প্রচন্ড ব্যস্ত রেখেছিলেন শব্দ ও তার উৎপত্তি এবং অর্থ সংক্রান্ত দার্শনিক বিতর্কে। এ প্রবন্ধে সে বিতর্কে আমরা যাব না।তবে একটু দেখে নেয়া যাক কি রকম অবস্থা বিরাজ করছিল তখনকার ব্যাকরণরচয়িতাদের মনে।

বেদকে কেন্দ্র করে প্রাচীন ভারতে ভাষা শাস্ত্রের বিকাশ। বেদের অংগ ছয়টি;-এদেরকে ষড়াংগ বলা হয়ে থাকে। এগুলো হচ্ছে-শিক্ষা,কল্প,ব্যাকরণ,নিরুক্ত,ছন্দ,জ্যোতিষ। লক্ষ্য করলে বুঝা যায় ছয়টির মধ্যে চারটিই হচ্ছে ব্যাকরণ সংক্রান্ত আলোচনা। বেদ অপৌরূষেয়;সুতরাং এটি পবিত্র। যেন তেন ভাবে পড়লে তার মান মর্যাদা বজায় থাকে না। ফলে বেদ পাঠ খুব কম মানুষের মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিল। নির্দিষ্ট বর্ণ বাদে কেউ বেদ পড়তেও পারত না। যদি কেউ পড়েও ফেলে তার অবস্থা কী হতে পারে সে বিষয়ে ভগবান(!)রামচন্দ্র আমাদের শিক্ষা দিয়ে গেছেন রামায়ণে – শুদ্র শম্বুককে হত্যা করে। শুদ্র শম্বুকের দোষ ছিল সে বেদ খানা পড়ে ফেলেছিল। সুতরাং এহেন পবিত্র বেদের পবিত্রতা রক্ষাকল্পে সমস্ত মেধা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তৎকালীন দার্শনিকেরা। ফলে বেদের সঠিক উচ্চারণ নির্দেশ করতে প্রথমে তৈরী হল ধ্বনিতত্ত্ব। চারটি বেদের প্রতিটির জন্য সৃষ্টি করা হয়েছিল একটি করে বিশেষ উচ্চারণ প্রণালী। এদেরকে বলা হয় প্রাতিশাখ্য। প্রাতিশাখ্যের রচনাকাল আনুমানিক খৃঃপূ ৫০০ থেকে ১৫০০ শতক। ধ্বনি বুঝানোর জন্য তারা বর্ণমালাকে ধরে এগিয়েছিলেন। আমাদের বর্ণমালার ক্রমিক অবস্থান সে সময় থেকেই নির্দিষ্ট করা। ধ্বনিতত্ত্বে বেশ উন্নতি করেছিলেন প্রাচীন ভারতীয় ভাষাতাত্ত্বিকেরা। তারা সমস্ত ধ্বনির উচ্চারণস্থল বেশ নির্ভুল ও সুস্পষ্টতার সাথে নির্দেশ করেছিলেন। ধ্বনিতত্ত্বের পরেই আসে শব্দ বাক্য ও অথর্তত্ত্ব। শব্দ ও অর্থের মাঝে লাগে প্রথম ঝামেলা।শব্দের সাথে অর্থের সম্পর্ক কী এ নিয়ে মোটামুটি দু ভাগে ভাগ হয়ে যায় ব্যাকরণবিদেরা। একদল বলল শব্দের ধ্বনিগুচ্ছের সাথে অর্থ সম্পর্কিত। অর্থ্যাৎ আমি যদি ‘কড়কড়’ শব্দটি উচ্চারণ করি তাহলে দেখা যাবে এ শব্দটির ধ্বনিগুচ্ছের সাথে এর অর্থের বেশ মিল আছে(অবশ্য যদি কেউ মিল দেখতে না চায় সেটা আলাদা কথা)। ধ্বন্যাত্নক শব্দগুলোর বিশ্লেষণে এ ধারণাটি বেশ স্পষ্ট হয়ে উঠে। যেমনঃ রিমঝিম,রিনিক ঝিনিক,কুল কুল ইত্যাদি শব্দের ধ্বনিগুচ্ছের সাথে অর্থের বেশ মিল পাওয়া যায়। যারা শব্দ আর অর্থের শ্বাশ্বত আর চিরায়ত সম্পর্কে বিশ্বাস করতেন তারা সমস্ত শব্দকেই এ রকম আর্থধ্বনিতাত্ত্বিক সম্পর্কে বিজড়িত বলে ভাবতেন।অন্যদিকে আরেক দল ছিল যারা মনে করতো শব্দ আর অর্থের সম্পর্ক চিরায়ত বা শ্বাশ্বত নয় :- এদের বদল ঘটে এবং এ সম্পর্ক আরোপিত। রবীন্দ্রনাথ ও হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বেশ জোর করে বাংলা ভাষার কিছু শব্দের আর্থধ্বনিতাত্ত্বিক সম্পর্ক দেখিয়েছিলেন। যারা শব্দ আর অর্থের মাঝে কোন বৈষম্য স্বীকার করতেন না তাদের বেশ কিছু দলের নাম যথাক্রমে – অদ্বৈতবাদী,শ্রুতিবাদী ও রক্ষণশীল বেদবাদী সম্প্রদায়। এ দলের প্রধান পুরূষেরা হলেন পাণিনি,পতঞ্জলী,ভর্তৃহরি,জৈমিনি ও আরো অনেকে।আর যারা শব্দ ও অর্থের মাঝে শ্বাশ্বত সম্পর্ক স্বীকার করতেন না তাদের মধ্যে আছে ন্যায়-বৈশেষিক,দ্বৈতবাদী আর প্রথাবাদীরা। আমরা যে একটি অর্থপূর্ণ বাক্যের তিনটি বৈশিষ্ট্য-আকাংখা,আসত্তি ও যোগ্যতা-সম্বন্ধে জানি তা কিন্তু এসেছে প্রাচীন ভারতীয় এ ব্যাকরণবিদদের কাছ থেকেই।

প্রাচীন ভারতীয়দের মতোই অনুসন্ধিসু ছিলেন প্রাচীন গ্রীসের পন্ডিতেরা। তবে ভারতীয় ঋষিদের মত তারা খুব একটা আকাশ বিহারের সু্যোগ নেননি। তবে এদের মাঝে ভাববাদ আর বস্তুবাদের বেশ একটা দ্বন্দ্ব ছিল তা তো আমরা জানিই। খ্রিপূঃ পাঁচ শতকে জন্ম নেয়া গ্রীক দার্শনিক প্রোটাগোরাসক প্রথম চার রকম বাক্য শনাক্ত করেন আর্থ মানদন্ডের উপর ভিত্তি করে।এগুলো হচ্ছে যথাক্রমেঃ প্রার্থনা,প্রশ্ন,বিবৃতি ও অনুজ্ঞা। কারো কারো মতে তিনি সাত শ্রেণীর বাক্য শনাক্ত করেন।গ্রীকরা ছিল তর্কপ্রিয় জাতি। ফলে সবকিছুকেই তার্কিক বিচারের মধ্য দিয়ে উত্তীর্ণ হতে হতো। সোফিস্টরা বাক্য নিয়ে বেশ গবেষণা করেছিলেন।তারা জ্যামিতিক কায়দায় ভেংগেছেন বাক্যকে-শ্রেণীকরণ করেছেন এদের এবং বক্তৃতায় কোন কোন বাক্য বিশেষ আবেদন সৃষ্টি করে তা নিয়ে ব্যাপক গবেষণা করেছেন। এদের মাঝেও ভারতীয় কায়দায় বিতর্কের সূচনা হয় শব্দ ও অর্থের স্বায়ত্ত্বশাসন নিয়ে।সক্রেটিস শব্দ ও অর্থের মধ্যকার চিরায়ত ও শ্বাশ্বত সম্পর্কে বিশ্বাস করতেন না। প্ল্যাটোও করেন নি। স্টোয়িকরা বিশ্বাস করতেন শব্দ ও অর্থের মাঝে সম্পর্ক চিরায়ত ও শ্বাশ্বত নয়। ফলে তারা যেখানেই বিশৃংখলা পেয়েছে সেখানেই শৃংখলা আনয়ন করতে চাইত। আর এরই ফলে জন্ম নিয়েছিল প্রথাগত ব্যাকরণ বা ট্র্যাডিশনাল গ্রামারের।

পরবর্তিতে খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতকে গ্রীক উপনিবেশ আলেকজান্দ্রিয়ায় রচিত হয় প্রথম প্রথাগত ব্যাকরণ বইয়ের। নাম-গ্রামাটিকি টেকনি।লেখক-ডায়োনিসিউস থ্রাক্স। গ্রীক ভাষার ধ্বনিতত্ত্ব ও রূপতত্ত্ব এ বইয়ের প্রধান আলোচ্য বিষয়। তারপর রোমান ও অন্যান্যরা আরো প্রথাগত ব্যাকরণের জন্ম দিয়েছেন। তবে পরবর্তিতে প্রিস্কিয়ান ষষ্ঠ শতাব্দীতে রচনা করেন এক বিশাল গ্রন্থ যা দুটি খন্ডে বিভক্ত;যথা-প্রিস্কিয়ান মাইনর ও প্রিস্কিয়ান মিনর। এ গ্রন্থটির ব্যাপক প্রভাব ছিল সমগ্র মধ্য যুগ জুড়ে।

সমস্যার শুরূ ও সমাপ্তির পথঃ

আসলে ব্যাকরণে সমস্যার আরম্ভ হয়েছে এর উদ্ভবের সময়কাল থেকেই। কেউ কেউ নিরপেক্ষ ও নৈর্ব্যাক্তিক বর্ণনা দিতে চেয়েছেন ভাষার। ফলে তৈরী হয়েছে বর্ণনাত্নক ব্যাকরণ বা Descriptive Grammar-এর। কেউ কেউ ধর্মগুরূ বা রাজাদের মতো শাসন করতে চেয়েছেন ভাষাকে। ফলে জন্ম নিয়েছে আনুশাসনিক ব্যাকরণ বা Prescriptive Grammar-এর। এ দুটোর মাঝে পার্থক্য হচ্ছেঃ বর্ণনাত্নক ব্যাকরণ বলে-‘দেখুন এই হচ্ছে ভাষা ‘ক’; ‘ক’ ভাষাটির কিছু নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য আছে’। আর আনুশাসনিক ব্যাকরণ বেশ ধমক দেয় আমাদের ; ক্রোধোন্মত্তস্বরে বলতে থাকে-“ ‘ক’ ভাষাটিতে এই এই বৈশিষ্ট্য থাকতেই হবে ; এই ভাবে ভাষাটি লিখতে হবে ; বলতে হবে এইভাবে ইত্যাদি ইত্যাদি’। আমাদের দেশের প্রচলিত বাংলা ব্যাকরণ পুরোটাই আনুশাসনিক।আমাদের প্রচলিত বাংলা ব্যাকরণ নির্দেশ দেয় নানা রকম। কোনটিতে বেশ যুক্তি আছে। তবে বেশিরভাগ নিয়মেরই যুক্তি নেই। তবে তার আগে দেখে নেই ব্যাকরণ সম্বন্দে আমাদের বোধ কী-

ভাষা আর ব্যাকরণের সম্পর্ক বেশ ঘনিষ্ঠ। ব্যাকরণ থাকলে ভাষা থাকবেই। ভাষাহীন কোন ব্যাকরণ হতে পারে না। তবে ভাষা থাকলেই যে ব্যাকরণ থাকবে এমন কোন কথা নেই। এখনও বিশ্বের অনেক ভাষার ব্যাকরণ নেই। যাদের ব্যাকরণ নেই তাদের নিয়ে এ আলোচনা নয়। আমরা দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখব আমাদের উপর – অর্থাৎ যে সমস্ত ভাষার ব্যাকরণ আছে তাদের উপর। তবে লক্ষ্যণীয় ব্যাপার হল যে সব ভাষার কোন লিখিত বা সুগঠিত ব্যাকরণ নেই সে ভাষার ভাষাভাষীরা প্রত্যেকেই কিন্তু প্রত্যেকের কথা বুঝে। এমন না যে ভাষার ব্যাকরণ নেই বলে তারা কেউ কারো কথা বুঝে না।আবার ভাষা ক্রমপরিবতর্নশীল। কয়েক শতাব্দীতে ঘটে যেতে পারে বেশ বড়সড় কোন পরিবর্তন। পৃথিবীর মৃত ভাষাগুলো বাদে প্রতিটি জীবিত ভাষার বৈশিষ্ট্য এটি। সুতরাং এটাকে একটা নিয়ম হিসেবে ধরা যায় প্রতিটি ভাষার। নিয়মটিকে বর্ণনা করলাম এভাবে-

১) ভাষা নিয়ত পরিবর্তনশীল।
২) ১ যদি সত্য হয় তবে এটাও সত্য যে কোন ভাষার ব্যাকরণ ভাষাকে বেঁধে ফেলতে পারে না।

৩) যে সমস্ত ব্যাকরণ ভাষাকে বেঁধে ফেলে শুদ্ধতা কিংবা অশুদ্ধতা যাচাই করে নানারকম নির্দেশ প্রদান করে তারা আনুশাসনিক।যদি ২ সত্য হয় তবে আনুশাসনিক ব্যাকরণ ভাষার স্বাভাবিক ব্যাকরণ হতে পারেনা।

৪) ৩ সত্য হলে এটা স্বীকার করতে হবে যে ব্যাকরণ ভাষার বর্ণনা দিতে পারে শুধু।

প্রথাগত ব্যাকরণবিদেরা ভাষার উপরোক্ত চারটি যুক্তিকে মেনে নেয়। তবে তাদের প্রধান সমস্যা হলো তারা ভাষা বর্ণনা করার সময় বুঝতে পারে না কোন একটি নির্দিষ্ট ভাষার অগনিত যে-বাক্য সমূহ আজো উচ্চারিত হয়নি তারা কিভাবে গঠিত হবে। যেমন- সাধু ভাষার যখন চল ছিল আমাদের দেশে তখন ব্যাকরণ রচয়িতারা ক্রিয়া পদের সাধু রীতির বর্ণনা দিয়েছেন। এবং এটা আনুশাসনিক রূপ পেয়ে গিয়েছিল। ফলে চলিত রীতির আবির্ভাবের সময় প্রথাগত ব্যাকরণের কাছে এ সূত্র ছিল না কীভাবে এ পরিবর্তনকে জাস্টিফাই করা যাবে। তাছাড়া কাব্যে ব্যবহৃত অসংখ্য বাক্যকে এ ব্যাকরণ ব্যাখ্যা করতে পারে না। বরং ওগুলো প্রথাগত ব্যাকরণের কাছে অশুদ্ধ। উদাহরণস্বরূপ জ়ীবনানন্দ রচিত একটি বাক্য এ রকম-

‘ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল।’

আর্থ বৈশিষ্ট্যের উপর বা শব্দের পৃথক অর্থের উপর জোর দিতে গিয়ে এ বাক্যটিকে প্রথাগত ব্যাকরণ বলবে অশুদ্ধ। কেননা প্রথাগত ব্যাকরণের মতে সাথর্ক বাক্যের তিনটি বৈশিষ্ট্য-আকাঙ্খা,আসত্তি ও যোগ্যতা। আর এ বাক্যটিতে,প্রথাগত ব্যাকরণের মতে,যোগ্যতার প্রচন্ড অভাব। ফলে বাক্যটি প্রথাগত ব্যাকরণের মতে অশুদ্ধ। শব্দের পৃথক অর্থের উপর জোর দিলে এ বাক্যটিকে বুঝা যায় না। কিন্তু পুরো বাক্য জুড়ে যে অর্থ বিরাজ করে তা যে কেউ উপভোগ করতে পারে। আরেকটি উদাহরণ নিতে পারি। বিশেষ্যের সংজ্ঞা নির্ণয়ে প্রথাগত ব্যাকরণ সাধারণত বলে থাকে – “যা কিছু নাম,তাই বিশেষ্য’। এটি একটি মারাত্নক ত্রুটি।কেননা ‘ভাল’, ‘সৎ’, ‘খারাপ’ ‘সবুজ’ ইত্যাদি শব্দগুলোকে প্রথাগত ব্যাকরণ অনুসারে আমরা বিশেষ্য বলতে পারি না। বলতে হয় বিশেষণ। অথচ কারো নাম অনায়াসেই রাখা যায় ‘সবুজ’। ফলে বাক্যে বিশেষ্যকে চেনার মত কোন সুনির্দিষ্ট অবস্থা থাকে না । প্রথাগত ব্যাকরণ ব্যাকরণের স্তরে স্তরে পরিচয় দেয় এ রকম ব্যর্থতার। এ সমস্ত ব্যর্থতার প্রতিক্রিয়া হিসেবে ইউরোপে জন্ম নেয় সাংগঠনিক ব্যাকরণ বা Structuralism-এর। এদের প্রধান পুরূষদের মধ্যে কয়েকজন হলেন ফার্দিনান্দ দ্যা সস্যুর,ত্রবেৎস্কয়,পেরারা ও জোন্স। সাংগঠনিক ব্যাকরণের উদ্ভব বিকাশ ও বিলয় গোটা উনিশ ও বিশ শতকের পরিধিতে। সাংগঠনিকেরা ভাষা থেকে আর্থ বৈশিষ্ট্য ঝেঁটিয়ে বিদায় করেছিলেন। তারা গুরূত্ব দিয়েছিলেন ভাষার রৌপ (morphological) বৈশিষ্ট্যের উপর। একটা উদাহরণের সাহায্যে দেখা যাক ব্যাপারট। উপরে প্রথাগত ব্যাকরণের বিশেষ্য পদের সংজ্ঞায় আমরা দেখেছি কীভাবে আর্থ বৈশিষ্ট্য ধূলোয় গড়াগড়ি খেয়েছে। সাংগঠনিকেরা এ বিষয়ে বেশ সতর্ক। তারা আর্থ বৈশিষ্ট্য বাদ দিয়ে ভাষার উপাদানগুলোর শারীরিক কাঠামো বা রূপের দিকে নজর দিলেন। যেমন সাংঠনিক ভাষাতত্ত্ব ইংরেজি আট প্রকার পদ বা পার্টস অব স্পিচ মেনে নিয়েছে। পার্টস অব স্পিচ গুলোর অনেকগুলোই রৌপ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। যেমন- কনজাংশন বা সংযোজন হচ্ছে একেবারে রৌপ একটি একক। কিংবা ধরে নিলাম adverb বা অব্যয়কে কেবলমাত্র তার রৌপ বৈশিষ্ট্য দেখে চেনা যায়। প্রিপজিশনগুলোও রৌপ একক। কিন্তু বিশেষ্য বিশেষণ বা ক্রিয়া নির্ণয় করতে গেলে কেবল রৌপ বৈশিষ্ট্য দেখলেই চলে না। আর্থ বৈশিষ্ট্যও প্রয়োজন হয়ে পড়ে। একটি উদাহরণঃ বাংলা বাক্যে কর্তার সাথে সংগতি রক্ষা করে ক্রিয়াপদ। এর সাথে জড়িত থাকে কাল ও বচন। আরো জড়িত থাকে সম্মান বা অসম্মানের বিষয়। যেমন- (১)জনাব রহমান আসছেন। এ বাক্যের ক্রিয়া কর্তা,কাল,বচন ও সম্মানিত না অসম্মানিত এ বিষয়গুলো আমলে নিয়ে তারপর পরিবর্তিত হয়েছে। এখন ঠিক এ রকমের আরেকটি বাক্য গঠন করা হল-

(২) জনাব টেবিল ডাসছেন।

এ বাক্যের সমস্ত রৌপ বৈশিষ্ট্যসমূহ বাক্য (১) এর রৌপ বৈশিষ্ট্যের সাথে একেবারে মিলে যায়। কিন্তু আমরা সবাই জানি যে বাক্যটি সঠিক নয়। কারণ বাক্যটি কোন অর্থ তৈরী করছে না। তাছাড়া সাংগঠনিক ভাষাতত্ব ভাষার রৌপ বস্তুগুলোকে নানারকম উপশ্রেণীতে ফেলে বাক্য তৈরী করতে চায়। ছোট্র একটি উদাহরণ দেই। উপরের বাক্য (১)এর রৌপ বস্তুগুলোকে সাংগঠনিকেরা নানারকম শ্রেণী ও উপশ্রেণীতে ফেলবেন। এবং আরো উপশ্রেণীকরণ করতেই থাকবেন। যেমন-‘রহমান’ বিশেষ্যপদটি পর্‍যালোচনা করে সাংগঠনিকেরা পাবেন-

১) রহমান একজন মানুষের নাম

ফলে ‘রহমান’-এর জায়গায় অন্য যে কারো নাম ব্যবহার করা যেতে পারে।
যেমন-জনাব আমীর আলী আসছেন।

২) ’রহমান’ পুং বাচক। সুতরাং যেকোন পুংবাচক শ্রেণীর অন্তর্গত হচ্ছে রহমান। সেক্ষেত্রে কুকুর মোরগ হাতি প্রভৃতি পুং শ্রেণীবাচক বিশেষ্য তাকে প্রতিস্থাপিত করতে পারে।

৩) ’রহমান’ সুদর্শন হতে পারে। (ফলে সুদর্শনা কিংবা রূপসী শ্রেণীবিভাগের অন্তর্গত হবেন না)

৪) ‘রহমান’ বিশেষ্যের আগে ‘জনাব’ যুক্ত হওয়াতে এটি নির্দেশ করে সম্মান সূচক পুরূষের শ্রেণীর অন্তর্গত তিনি। (যদিও ইদানীং জনাব,সভাপতি ইত্যাদি শব্দগুলো স্ত্রী পুরূষ নির্বিশেষে ব্যবহৃত হচ্ছে। এটাকে আমলে নিলে জটিলতা আরো বেড়ে যায়।)

এরকম শ্রেণীকরণের পর শ্রেণীকরণ করা যায়। ফলে মাঝখান থেকে ব্যাকরণ বলতে আর কিছু থাকে না। তাছাড়া সাংগঠনিকেরা আক্রান্ত হয়েছিলেন ‘আচরণবাদ’ বা Behaviorism দ্বারা। তারা ভাবতেন মানুষ কোন যন্ত্রসদৃশ প্রাণী যা কিনা শুধু বিশেষ উদ্দীপনায় সাড়া দিতে সক্ষম বা দিয়ে থাকে। সুতরাং মানুষের ভাষাও কোন উদ্দীপনার ব্যাপার। সাংগঠনিকেরা উদ্দীপক খুঁজতে গিয়ে আবিষ্কার করেন তাদের করতে হচ্ছে নানারকম শ্রেণীকরণ।

সাংগঠনিক ভাষাবিজ্ঞানের ব্যার্থতার ফলশ্রুতিতে বিশ শতকের মধ্য দশকের শেষের দিকে জন্ম হল সৃষ্টিশীল রূপান্তরবাদী ব্যাকরণ বা transformational generative grammar-এর। নোয়াম চমস্কি এ ধারার স্রষ্টা। রূপান্তরবাদী ব্যাকরণ পপার প্রস্তাবিত ‘ফলসিফিকেশন ও ডিমার্কেশন’ এর নীতি মেনে চলে। রূপান্তরবাদী ব্যাকরণ মনে করে প্রণালী তৈরী করা কোন উন্নত ভাষিক ব্যাকরণের বৈশিষ্ট্য নয়। প্রণালী, যেটাতে সাংগঠনিকেরা বেশ গুরুত্ব দিয়ে থাকেন,জরূরীঃ- তবে তার চেয়েও বেশি জরূরী কোন ভাষার ভাষিক তত্ত্ব।রূপান্তর ব্যাকরণ মনে করে মানুষ অনবরত ভাষা সৃষ্টি করে থাকে। আমরা যেকোন ছোট শিশুর দিকে তাকালে এ তত্ত্বের সত্যতা পাই। শিশু একটি ভাষার সমস্ত বাক্য মুখস্ত করে রাখে না। বরং প্রয়োজনানুসারে তা সৃষ্টি করে থাকে। এবং একটি নির্দিষ্ট ভাষিক অঞ্চলে যে কেউ তার কথা বুঝতে পারে। অর্থ্যাৎ বাক্য তৈরীর ক্ষমতা শিশুটির মাঝে সহজাতভাবেই থাকে। শুধু দরকার তাকে যেকোন একটি ভাষিক অঞ্চলে বড় করে তোলা। রূপান্তর ব্যাকরণের মতে ‘ভাষাবোধ’(competence) আর ‘ভাষাপ্রয়োগ’(Performance) দুটি একই বিষয় নয়। একটি নির্দিষ্ট ভাষার সমস্ত বাক্য বুঝা ও তা সৃষ্টি করার নাম হলো ভাষাবোধ। আর কোন একটি ‘ভাষাবোধ’ কে কোন নির্দিষ্ট অঞ্চলের অধিবাসীরা বা ব্যক্তি-মানুষ কীভাবে প্রকাশ করবে তা হচ্ছে তার ভাষাপ্রয়োগ। রূপান্তরবাদীরা মনে করে সারা দুনিয়ার মানুষদের মনে একই রকম ভাষাবোধ কাজ করে থাকে বা সব মানুষ ধারণ করে থাকে একটি সাধারণ ভাষাতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য। কেননা দেখা যায় যে মোটামুটি বিশ রকম ধ্বনিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য বিরাজ করছে সারা দুনিয়ায়। একেক ভাষা স্বতন্ত্রভাবে ঐ ধ্বনিরাশি থেকে বেছে নেয় তার জন্য নির্দিষ্ট ধ্বনিসমষ্টি।যে ভাষাসমূহের ধ্বনিতাত্ত্বিক পার্থক্য কম অর্থ্যাৎ যারা নিজেদের মধ্যে শেয়ার করে অভিন্ন ধ্বনিরাশি তারা একই গোত্রবদ্ধ। আবার যেহেতু ‘বাক্য’ অসীম-কেননা কোন ভাষায় নতুন বাক্য তৈরী করা যায় অসীমসংখ্যক-আর ধ্বনিসমষ্টি সসীম;সুতরাং এ ধারণা রূপান্তরবাদীরা করে থাকে যে পৃথিবীর ভাষাসমূহের মাঝে আভ্যন্তরীন মিল খুবই বেশী। পার্থক্য শুধু উপরিকাঠামো বা বহির্তলে। রূপান্তরমূলক সৃষ্টিশীল ব্যাকরণ এ পর্যন্ত নানাভাবে সংশোধিত হয়েছে এবং উতরে যাচ্ছে নানারকম উপাত্ত ব্যাখ্যায়। অর্থ্যাৎ ফলসিফিকেশনের প্রক্রিয়ায় এখনো পর্যন্ত সফল হয়ে আছে রূপান্তরমূলক সৃষ্টিশীল ব্যাকরণ।

এছাড়াও ভাষা ব্যাখ্যায় আঠারো উনিশ শতক জুড়ে প্রচলন ছিল তুলনামূলক ও ঐতিহাসিক ভাষাতত্ত্বের। এশিয়াটিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা উইলিয়াম জোন্স এ ধারার স্রষ্টা। এতে সারাবিশ্বের বিভিন্ন ভাষাকে বিভিন্ন গোত্রবদ্ধ করা হয়েছিল। বিশেষ করে সংস্কৃত ভাষা আবিষ্কারের পর এ ভাষিক তত্ত্ব/প্রণালীর উদ্ভব ঘটে।

ভাষা নিয়ে পাশ্চাত্যে বেশ কাজ হচ্ছে। সাইকোলিংগুইস্টিক নিয়ে একটা নতুন ধারার খবর পাওয়া যাচ্ছে। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবংগ মিলিয়েও বাংলা ভাষার জন্য তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু করা হয়নি। জাতি হিসেবে এটা আমাদের ব্যার্থতা।

তথ্যসূত্রঃ
১) সিন্ট্যাকটিক স্ট্রাকচারস(নোয়াম চমস্কি)
২) বাক্যতত্ত্ব (হুমায়ুন আজাদ)
৩) তুলনামূলক ও ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞান( হুমায়ুন আজাদ)
৪) আস্পেক্টস অব দ্যা থিওরী অব সিন্ট্যাক্স (নোয়াম চমস্কি)
৬) বাংলা শব্দতত্ত্ব(রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
৫) ঊইকিপিডিয়া